এটা ইতিহাস চর্চার সময় নয়: ইনু

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরির জন্য জাসদকে দায়ী করে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য ‘অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও অপ্রাসঙ্গিক’ বলে মন্তব্য করেছেন দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু; তিনি বলেছেন, ‘ইতিহাস চর্চার সময়’ এটা নয়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2016, 05:29 AM
Updated : 15 June 2016, 10:33 AM

ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের ওই বক্তব্যের দুদিন পর বুধবার তথ্যমন্ত্রী ইনুর এই প্রতিক্রিয়া এল।

সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে ইনু বলেন, “আমরা মনে করি এই সময়ে ১৪ দলের অভ্যন্তরে কোনো কাদা ছোড়াছুড়ি করা উচিত নয় এবং এটা ইতিহাস চর্চার সময় নয়। এটা জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার সময়, জনগণকে নিরাপত্তা বিধান করার সময়।

“সেইজন্য আমি মনে করি যে, আমাদের জাসদ নিয়ে বা যে কোনো দল নিয়ে যে মন্তব্য, বক্তব্য ও বিবৃতি আসছে সেটা অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও অপ্রাসঙ্গিক।”

জাসদ নিয়ে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য নিয়ে গত দুদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গন ও গণমাধ্যমে চলছে নানামুখী আলোচনা।

জাসদে ইনুর অংশের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার মঙ্গলবার বলেন, “শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে যখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, হাসানুল হক ইনু যখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করবে।”

অবশ্য ইনু বলেছেন, সৈয়দ আশরাফের মন্তব্যে ১৪ দলের ঐক্যে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেই তিনি মনে করেন।

“জাসদ ও আওয়ামী লীগের ঐক্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বারবারই বলেছি যে গভীর বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সুতরাং এ ধরনের মন্তব্যে এ ঐক্য ও চলার পথ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”

ওই ‘ঐক্য ইতোমধ্যে দেশের জন্য মঙ্গলজনক’ প্রমাণিত হয়েছে মন্তব্য করে ১৪ দলের শরিক নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, “এই মুহূর্তে কোনো উসকানিতে পা দেবেন না, উত্তেজিত হবেন না, ধৈর্য রাখুন, ঐক্য রাখুন। তা-ই দেশকে নিরাপত্তা দেবে।”

জাসদ পরিক্রমা

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তাদের কথিত তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে।

সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা ছিল জাসদের। এ লক্ষ্যে গণবাহিনী নামে তাদের সামরিক শাখাও তৈরি হয়। সেই গণবাহিনীর বিরুদ্ধে রাজনীতিবহির্ভূত সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে গৃহবন্দি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেন গণবাহিনীর সামরিক অধিনায়ক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের।

পরে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের নামে কর্নেল তাহেরকে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আদালতের এক রায়ে একে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে এর জন্য জেনারেল জিয়াকে দায়ী করা হয় কয়েক বছর আগে।

পরে জাসদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে যুক্ত হয় এবং বর্তমানে ১৪ দলীয় জোটেও দলটি রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়েই এমপি নির্বাচিত হন পঁচাত্তরপূর্ব জাসদের সামরিক শাখার উপ-প্রধান হাসানুল হক ইনু। 

২০১২ সালে তাকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটের পর আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করলে ইনুকে আগের দপ্তরেই রাখেন তিনি।   

স্বাধীনতার পর জাসদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ অভিযোগ করেন, জাসদ নেতা-কর্মীরা সে সময় মুক্তিযুদ্ধকে ‘বিতর্কিত করার’ চেষ্টা করছিল। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগেই দেশকে ‘ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা’ করেছিল।

“তারা যদি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সমস্ত পরিবেশ সৃষ্টি না করত, তবে বাংলাদেশ একটি ভিন্ন বাংলাদেশ হত,” বলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর পঁচাত্তরে হত্যাকাণ্ডের শিকার সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আশরাফ।

জাসদকে ‘হঠকারী’ দল আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “এদের একজনকে আবার মন্ত্রিত্বও দেওয়া হয়েছে, যার প্রায়শ্চিত্ত আওয়ামী লীগকে আজীবন করতে হবে।”

এর জবাবে ইনু বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “মনে রাখতে হবে, বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের প্রতিটি ঘটনা এখনও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করা আছে, ইতিহাস ইতিহাসের মতোই বিশ্লেষণ করবে।

“বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে যে তল্পিবাহক-তোষামোদকারী গোষ্ঠী ছিল তারা বা প্রকাশ্য বিরোধিতাকারী জাসদ- কার কতটুকু ভুল, বা কে কতটুকু ক্ষতি করেছে, বা ক্ষতি করেনি- তার মূল্যায়নটা ইতিহাসই করবে।”

ইনু বলছেন, জঙ্গিরা যেভাবে সাধারণ জনগণকে হত্যা করছে- সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। সাধারণ জনগণ এবং দেশের নিরাপত্তা বিধানের জন্য দরকার ‘সর্বাত্মক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা’। আর সেজন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দল-মহাজোট ‘একসঙ্গে’ কাজ করে যাচ্ছে।

“মনে রাখবেন, বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কতটুকু ভুল করেছে, জাসদ কতটুকু ভুল করেছে- তা বিচার-বিশ্লেষণ করার সময় এটা নয়। তবে এটা ইতিহাস বিচার করবে। ইতিহাসের নিরীখে সবকিছু মূল্যায়িত হবে।

“মনে রাখতে হবে, খোদ শেখ হাসিনা বার বার বলেছেন, প্রতিক্রিয়াশীল, দেশবিরোধী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক নিহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে দায়ী করাটা ইতিহাসসম্মত কোনো বক্তব্য নয়।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের ঐক্য হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তথ্যমন্ত্রী।

“আমরা মনে করি, পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনার পূর্বাপর সকল ঘটনার গভীর বিশ্লেষণ করে আওয়ামী লীগ, জাসদ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঐক্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা জাসদও সেই ঐক্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ‘সাম্প্রদায়িকতা ও সামরিক শাসনের জঞ্জাল থেকে’ উদ্ধার করে অসাম্প্রদায়িকতার পথে, গণতান্ত্রিকতার পথে, সংবিধানের পথে পরিচালিত করা সম্ভব হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। 

সৈয়দ আশরাফ জাসদ নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশনে তার সমর্থন এসেছে জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদের কাছ থেকে, যিনি এক সময় ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন।

তিনি বলেন, “আমরা ছাত্রলীগ করতাম। একসাথে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, এক বিছানা থেকে উঠে এসে উনি আমাদের উদ্দেশ্যে অস্ত্র ধরেছেন। গুণে গুণে আমাদের ২০ লক্ষ লোককে হত্যা করল। সেদিন যদি গণবাহিনী গঠন করে বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এভাবে হত্যা না করত, তাহলে দেশে দুর্দিন হত না।  বঙ্গবন্ধুর মতো এতবড় জাতীয় নেতাকে আমরা হারাতাম না। সেজন্য জাতি আজ পর্যন্ত ভুগছে।”

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও গুম-খুন নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে তাদের জোটসঙ্গী জাসদকেই দায়ী করেছেন।

মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে জাসদকে ইঙ্গিত করে খালেদা বলেন, “এই দলের লোকজন তখন আওয়ামী লীগের লোকজনকে খুন করত, গুম করত। তাদের নেতার সম্পর্কে কী খারাপ ভাষায় বক্তব্য দিত, যে খারাপ ভাষা ব্যবহার করত, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করত!

“সেগুলোকে এখন হাসিনা ভুলে গিয়ে নিজের দলের লোকজনকে মূল্যায়ন না করে এই খুনি-অত্যাচারীদের মূল্যায়ন করছে। তার ফলেই দেশের এই অবস্থা হচ্ছে।”

অবশ্য জাসদের অন্য দুটি অংশ সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে।

একাংশের সভাপতি আ স ম আবদুর রব, যিনি শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালের সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যকে ‘অগ্রহণযোগ্য, অন্যায্য ও অনভিপ্রেত’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী।”

জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান নেতৃত্বাধীন অংশ আরেক বিবৃতিতে বলেছে,মন্ত্রী  ইনুর ‘অতি চাটুকারিতার জন্য’ তাবৎ জাসদ সংগঠন ও নেতা-কর্মীদের উপর আঙুল তোলা ‘অযৌক্তিক’।

আর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের জাসদ নিয়ে তার দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যকে তার ‘ব্যক্তিগত মত’ বলে মনে করছেন।

জাসদ থেকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগকে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে- সৈয়দ আশরাফের এমন বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইনু বলেন, “ওগুলো আমাদের মাথাব্যথা না। কে মন্ত্রী হবেন আর কে মন্ত্রী হবেন না- ওটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আমার মনে হয় তার এ এখতিয়ারে হস্তক্ষেপ করা উচিত না।”

বাংলাদেশকে ‘রক্ষা’ করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে মন্তব্য করে ইনু বলেন, “আমরা সেই ঐক্যের নীতিতে বিশ্বাস করি এবং আমরা মনে করি জাসদ শতভাগ আন্তরিক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল।” 

আরও পড়ুন