মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সেমিনারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক তার প্রবন্ধে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে জামায়াতে ইসলামী বহুবার মতাদর্শের বদল ঘটিয়েছে বলে অভিমত দিলে অধ্যাপক খান বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ধারণ করলেও তাদের চরিত্রের হেরফের হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফা তার প্রবন্ধে বলেন, ১৯৪১ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে রাষ্ট্রকাঠামো, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের অবস্থান সুবিধা পেলেই বদলে ফেলেছে জামায়াত।
তার ভাষায়, বাংলাদেশে বিএনপিসহ ডানপন্থিরা জামায়াতের ‘পরীক্ষিত বন্ধু’। আর তাদের ‘শত্রু’ হল তারা, যারা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে ‘হোয়েন কনফেশনাল পার্টিজ কম্প্রোমাইজ ইডিওলজি: এ কম্পারেটিভ স্টাডি অব জামায়াত-ই-ইসলামী ইন পাকিস্তান, বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মামুন মোস্তফা।
প্রবন্ধকার মামুন মোস্তফা বলেন, অন্য অনেক রাজনৈতিক দলের মতোই যেখানে লাভ দেখেছে, বিনা দ্বিধায় সে পথে গেছে জামায়াত।
“জামায়াত পাকিস্তানের বিরোধিতা করলেও ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব পাকিস্তানে চলে যায়।”
পাকিস্তানের শুরুর দিকের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, সে সময় পাকিস্তান মুসলিম লীগ জামায়াতের দৃষ্টিতে ‘যথেষ্ট মুসলিম দল’ ছিল না। জামায়াত মনে করল, পাকিস্তানের মুসলমানদের কাছে নিজেদের ‘সাচ্চা মুসলমান’ হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে ভোট পাওয়া সহজ হবে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে তারা তখন মনোনিবেশ করে।
এরপর একাত্তরে সেই জামায়াতই পাকিস্তানের বিভক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দলটির কর্মীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে হত্যা, গণহত্যার মতো যুদ্ধাপরাধে সরাসরি অংশ নেয়, যা চার দশক পর আদালতের রায়েও প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, জামায়াত শুরুর দিকে প্রচার করত, পশ্চিমা ঘরানার রাষ্ট্র কাঠামো ও জাতীয়তাবাদে তারা বিশ্বাসী নয়। নিজেদের গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদবিরোধী বলেও তারা দাবি করত। কিন্তু গবেষণায় তাদের পুঁজিবাদরোধীতা দেখা যায়নি।
“তারা ছিল নারী নেতৃত্ব, এমনকি সংখ্যালঘুরও বিরুদ্ধে। জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল হুকুমতে ইলাহি প্রতিষ্ঠা করা।”
বাংলাদেশে জামায়াতের পরীক্ষিত বন্ধু কারা- এমন প্রশ্ন রেখে প্রবন্ধকার বিএনপি এবং অপরাপর ডানপন্থিদের দেখিয়ে দেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও এক সময় জামায়াতের বন্ধুত্ব হয়েছিল। পাকিস্তানেও তারা পাকিস্তান পিপলস পার্টি ছাড়া সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই জোট করেছে। ১৯৭১ সালে পিপিপির সঙ্গেও তাদের ‘আঁতাত’ ছিল।
জামায়াত কাদের শত্রু মনে করে?
মামুন মোস্তফা বলছেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের’ জামায়াত শত্রু বলে গণ্য করে, আখ্যায়িত করে ‘কাফের-মোনাফেক-নাস্তিক’ হিসেবে।
“গোলাম আযম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নামে একটি বই লিখেছেন। এই বই পড়লেই এটা বোঝা যায়। এটা কেবল কথার কথা নয়।”
জামায়াতের রাজনীতির বৈপরীত্যের প্রমাণ দিতে গিয়ে মামুন মোস্তফা বলেন, বাংলাদেশে জামায়াত যাদের কাফের-মোনাফেক বলে শত্রু জ্ঞান করছে, ভারতের জামায়াত সেই শ্রেণিকেই, অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বন্ধু বলছে।
“১৯৯৬ সালে ভারতীয় জামায়াতের তৎকালীন মুখপাত্র এক নিবন্ধে সেকুলারিজমকে স্রষ্টার পক্ষ থেকে এক আশীর্বাদ হিসেবে বর্ণনা করেন।”
বিতর্কিত ইসলামী তাত্ত্বিক সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠা পায় জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর মওদুদী পাকিস্তানে চলে যান।
পাকিস্তানে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে দুই দফা নিষিদ্ধ হয় জামায়াতে ইসলামী। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশে আবারও জামায়াতের পুনর্বাসন ঘটে।
উপমহাদেশের তিন দেশে জামায়াতের পরিবর্তনের স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে প্রবন্ধকার বলেন, মওদুদীর লেখা পড়িয়ে এখনও জামায়াত কর্মী সংগ্রহ করে। অর্থাৎ, তাত্ত্বিক দিক দিয়ে মওদুদীর লেখা এখনো জামায়াতের কাছে ‘রিলেভেন্ট’। কিন্তু দলীয় নীতি কাঠামো ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে।
“কেবল আদর্শ দিয়ে তাদের ব্যাখ্যা করা মুশকিল। বরং সুযোগ অনুযায়ী আচরণ দেখলে তাদের বেশি ব্যাখ্যা করা যায়।”
তার পর্যবেক্ষণ, জামায়াত পাকিস্তানে সবচেয়ে কম বদলেছে; বাংলাদেশে খানিকটা বদলেছে; আর ভারতে সবচেয়ে বেশি বদলেছে।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের পরিবর্তনগুলো দেখিয়ে তিনি বলেন, “জামায়াত সুখে থাকলে খুব কম বদলায়। চাপে থাকলে বেশি বদলায়।... আদর্শ ও স্বার্থ যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, তখন জামায়াত স্বার্থকেই গ্রহণ করেছে।”
জার্মানির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির দৃষ্টান্ত টেনে মামুন মোস্তফা বলেন, বদলের ধারায় এই জামায়াতও একদিন ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারে।
তার প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ইসলামে যেমন একটি বিপ্লবী ঐতিহ্য আছে, তার বিপরীতে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ঐতিহ্যও রয়েছে।
“বহুরকম ঐতিহ্য আছে। ইসলামের ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল ঐতিহ্যের সন্তান জামায়াত।”
ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওল্টান সলিমুল্লাহ খান।
“একাত্তরে আওয়ামী লীগের আসন শূন্য ঘোষণার পর জামায়াত সেটার সুযোগ নিল। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশগ্রহণ করারও একটা সুযোগ ছিল, জামায়াত সেটা নেয়নি।”
জামায়াত ১৯৪৭ সালে যে পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিল, ১৯৭১ সালে সেই পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে দলটির বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার ইতিহাস তুল ধরে তিনি বলেন, “তাহলে জামায়াত প্রতিবার ভুল করছে, জামায়াত বদলাচ্ছে, তাহলে প্রতিবারই ভুল করবে। কারণ তাদের কাঠামোর মধ্যে ভুল আছে।”
১৮৮০ সালে জন্ম নেওয়া সুলতান গালিব সোভিয়েত শাসক স্তালিনের আমলে ১৯৪০ এর দশকে নিখোঁজ হয়ে যান। তার আগে ১৯১৭ সনে তিনি বলশেভিকদের সঙ্গে যোগ দেন এবং ১৯১৮ সালে লেনিনের জাতি বিষয়ক কর্মসূচিতে অংশ নেন। মুসলিম জীবনের বৈচিত্র্যকে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মুসলিম কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ধারণা পোষণ করতেন।
সুলতান গালিবকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক খান বলেন, “ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন সকল মুসলিম প্রলেতারিয়েত।”
“গালিব রাশিয়ার অধীন মুসলিম দেশগুলোরও মুক্তি কামনা করেছিলেন। তার প্রতি লেনিনেরও সমর্থন ছিল। এটা মুসলমানদের বিপ্লবী ঐতিহ্য,” বলেন তিনি।
ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ দিকে কেন জামায়াত গঠিত হলো- সেই প্রশ্ন রেখে আলোচনা এগিয়ে নেন এই অধ্যাপক।
“ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম পার্থক্যটাকে রাজনীতির কেন্দ্রে আনল ব্রিটিশ সরকার। সেটাকে কেন্দ্র করে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা করল। এই দুই জাতিকে আলাদা হিসাবে বারবার মনে করিয়ে দেওয়ায় নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’।”
সেই প্রেক্ষাপটে জামায়াতকে তুরস্কের খেলাফতসহ অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার কথা বলেন তিনি।
প্রশ্নোত্তর পর্বে নারী নেতৃত্ব প্রসঙ্গে জামায়াতের একটি নির্বাচনী ইশতেহারকে উদ্ধৃত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এমএম আকাশ।
“সেখানে তারা বলেছেন, দেশের মানুষ যেহেতু নারী নেতৃত্বকে মেনে নিয়েছে, তাই এ বিষয়ে তারা আপাতত কথা বলছে না। তবে দেশের মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হলে তখন এটা নিয়ে তারা কথা বলবে।”
জামায়াতের এই অবস্থান বদলকে তাদের সাময়িক রাজনৈতিক কৌশল হিসাবেই চিহ্নিত করেন আকাশ।
উচ্চতর সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “এই প্রবন্ধে একটি আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। এখানে অনেক বিষয় এসেছে। অনেকে মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়গুলোকে যুক্ত করে আগামী ডিসেম্বরে আমরা জার্নালে এটি প্রকাশ করব।”