বিএনপির অর্ধ কোটি বেশি ভোট আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের

নবম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ ভোট পেয়েছে; বিএনপি পেয়েছে প্রায় ৯৫ লাখ ভোট।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2016, 04:38 PM
Updated : 24 June 2021, 08:10 AM

তবে তৃণমূলের সবচেয়ে জনপ্রিয় নির্বাচন হিসেবে পরিচিত এই ভোটে ক্ষমতাসীন দলটির মূল লড়াই হয়েছে মনোনয়নবঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে। স্বতন্ত্র এসব প্রার্থী পেয়েছেন দেড় কোটিরও বেশি ভোট।

ছয় ধাপে চার হাজারেরও বেশি ইউপির ভোটের ফল বিশ্লেষণে এসব তথ্য মিলেছে।

নির্বাচনে নৌকা প্রতীক জয় পেয়েছে ২৬৭০ ইউপিতে, বিএনপি ৩৭২ ইউপিতে আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৮৮০ ইউপিতে। বাকিগুলোয় রয়েছেন জাতীয় পার্টি, জাসদ, জেপি ও কয়েকটি দলের প্রার্থী।

স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে তৃণমূলের এই নির্বাচনে এবারই প্রথম চেয়ারম্যান পদে দলভিত্তিক ভোট হয়েছে। এতে ভোটার ছিল ৬ কোটি ৭৫ লাখের বেশি।

চার হাজারের বেশি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ধানের শীষ প্রতীকের সাত গুণেরও বেশি। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীনদের এক তৃতীয়াংশের সমান।

ইউপিভিত্তিক জয় ও ভোটারের এমন তারতম্যের পরও ক্ষমতাসীনদের ‘নিরঙ্কুশ’ জয়কে কোনোভাবেই জনপ্রিয়তার মাপকাঠি মানছেন না পর্যবেক্ষকরা।

তারা বলছেন, এবার ক্ষমতাসীন ও তাদের বিদ্রোহীদের মধ্যেই মূল লড়াই হয়েছে। দশম সংসদের বাইরে থাকা নবম সংসদের বিরোধী দলটি ইউপিতে ‘গা লাগিয়ে’ ভোট করতে পারেনি। সেই সঙ্গে সহিংসতা, দখল, কারচুপি ও সন্ত্রাসের কবলে ছিল এ ভোট।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতী ও জানিপপ-এর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সংসদের ভোটের মতো ভিন্ন বলয়ের স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহজ সরলীকরণও সঠিক হবে না। সুষ্ঠুভাবে ভোট না হওয়ায় তৃণমূলের ভোটের এ চিত্র প্রকৃতপক্ষে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হতে পারে না।

ভোটের হার: আওয়ামী লীগ ৪৭%, বিএনপি ১৯% ও স্বতন্ত্র ৩০%

নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, প্রথম ধাপে ৭৪ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৭৮ শতাংশ, তৃতীয় ধাপে ৭৬ শতাংশ, চতুর্থ ধাপে ৭৭ শতাংশ, পঞ্চম ধাপে ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ ও ষষ্ঠ ধাপে ৭৬ শতাংশ ভোট পড়েছে।

এরমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৪৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, বিএনপি ১৮ দশমিক ৮১ শতাংশ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে।

নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা ছয় ধাপে ভোট পেয়েছে ২ কোটি ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার ৬২৬টি।

এর মধ্যে প্রথম ধাপে ৪৩ লাখ ২৫ হাজার ৬২০, দ্বিতীয় ধাপে ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৭৭৭, তৃতীয় ধাপে ৩৪ লাখ ৫৩ হাজার ৯০২, চতুর্থ ধাপে ৩৯ লাখ ৬১ হাজার ১৯২, পঞ্চম ধাপে ৪২ লাখ ২৮ হাজার ৬১৮ এবং শেষ ধাপে ৩৯ লাখ ২২ হাজার ৫১৭ ভোট পড়েছে নৌকায়।

ধানের শীষে মোট ভোট পড়েছে ৯৪ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯০টি।

এরমধ্যে প্রথম থেকে ষষ্ঠ ধাপে পর্যায়ক্রমে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫৩১, ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৩, ১৫ লাখ ১৫ হাজার ৩, ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৭১৮, ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৮ এবং ১৫ লাখ ৬৬ হাজার ৯৩৭ ভোট পেয়েছে বিএনপি।

গড়ে প্রতি ধাপে ২৭ লাখেরও বেশি ভোট পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। চতুর্থ ধাপে ২৯ লাখ ৫৮ হাজার ৫২৯, পঞ্চম ধাপে ২৮ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৮ ও শেষ ধাপে ২৭ লাখ ৯৮ হাজার ৮০৩ ভোট পেয়েছেন তারা। এর আগের তিন ধাপের তাদের ভোট ৮৪ লাখের বেশি।  

দশম সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ১ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে।

ছয় ধাপে আ. লীগ ২৬৭০, বিএনপি ৩৭২

ভোটে অন্তত দেড় ডজন দল অংশ নিলেও দলীয় মূল লড়াই হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। ছয় ধাপে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থীরা ২৬৭০ ইউপিতে ও ধানের শীষের প্রার্থীরা ৩৭২ ইউপিতে জয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন ৮৮০ জন।

জাতীয় পার্টি অর্ধশত ইউপি, জাসদ এক ডজন ইউপিতে এবং জেপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দলও জিতেছে এ ভোটে।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সহিংসতা

ইসির জনসংযোগ শাখার কর্মকর্তারা জানান, এবার ছয় ধাপে ২২০ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। শেষ পর্যায়ে ভোট বন্ধ হওয়ায় দুই জন বাদ পড়েছেন এ তালিকা থেকে।

বিনা ভোটে পার এর এ তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ২১৫ জন। আর তিন জন স্বতন্ত্র।

প্রথম ধাপে ৫৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩৪ জন, তৃতীয় ধাপে ২৯ জন, চতুর্থ ধাপে ৩৫ জন, পঞ্চম ধাপে ৪২ জন ও শেষ ধাপে ২৪ জন নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি তফসিল ঘোষণার পর ভোটের ছয়দিন ৩৮ জন ও ভোটের আগে-পরে সহিংসতায় আরও অন্তত ৬৫ জনের প্রাণহানির তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে।

এর আগে ১৯৮৮ সালে এইচ এম এরশাদের শাসনামলে একদিনের দেশব্যাপী ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে সর্বোচ্চ ১০০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এবং সহিংসতায় ৮০ জনের প্রাণহানির তথ্য পাওয়া গেছে।

২০০৩ সালে বিএনপি শাসনামলে তিন মাসব্যাপী ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় অন্তত ৮৩ জনের প্রাণহানির এবং ৩৪ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার তথ্য রয়েছে ইসির কাছে।

‘জনপ্রিয়তার মানদণ্ড হতে পারে না এ ভোট’

ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুর্শিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভোটের প্রক্রিয়া সুষ্ঠু না হলে জয়ের রেকর্ড ও ভোট পড়ার হার দিয়ে জনপ্রিয়তা যাচাই কোনো মানদণ্ড হতে পারে না। এ নির্বাচনে যা হয়েছে তা দুঃখজনক, যা আগের সব নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অর্জন ম্লান করে দিয়েছে।

“ইউপি ভোটে সব অনিয়ম ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেভাবে পার হল এবং সহিংসতা, কারচুপি, জালভোট, সন্ত্রাসের মাধ্যমে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে কোনোভাবে জেতা ফল নিয়ে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি নির্ণয় করা যাবে না। এভাবে জেতা জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় সরকারে কী ভূমিকা রাখেন- তা-ই এখন দেখার বিষয়,” বলেন তিনি।

সঠিকভাবে ভোট দিতে পারলে এবং তার প্রতিফলন থাকলে নির্বাচনের ফল নিয়ে মানদণ্ড করা যেত বলে মনে করেন শারমিন।

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপ চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন, এবার ইউপি ভোট আওয়ামী লীগ ও তার বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়েছে। বিএনপি তো ‘গা লাগাতেই’ পারে নি। সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচন ভিন্ন বলয়ের ভোট। একই প্রতীকে নির্বাচন হলেও সংসদের মতো করে ইউপির ফলকে সরলীকরণ করলে তা সঠিক হবে না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এতো কিছুর পরও ভোট শেষ হয়েছে। এখন হারজিতের সহজ অংক কষে লাভ হবে না। দলগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা এলে এবং ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হলেই তা নিয়ে অংক করা যেত।”

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ অবশ্য এবারের ইউপি ভোটকে আগের চেয়ে ভালো নির্বাচন বলে মনে করেন। তার আশা, সামাজিক অস্থিরতা দূর হলে ও মানসিক পরিবর্তন হলে ভবিষ্যতে সহিংসতা-অনিয়ম ছাড়াই ভোটের পরিবেশ তৈরি হবে।

নির্বাচন সার্বিকভাবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলেও দাবি সিইসি কাজী রকিবের।

আ. লীগ জাপা বিএনপির মত

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ রোববার অভিযোগ করেছেন, সরকারকে চাপে রাখতে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া লোকদেরও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সহিংসতায় মারা গেছে বলে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে।

এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করলে এই ধরনের সহিংস ঘটনা কমে যেত। তারা শুরু থেকেই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এই নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পথ বেছে নিয়েছে।”

নির্বাচনে অনিয়ম-সহিংসতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেছেন, এই নির্বাচন ও তা আয়োজনকারী নির্বাচন কমিশন উভয়ই এর মধ্য দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন হলে এ সহিংসতা রোধ করা যেত। এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রমাণ হয়েছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাক, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এখন দরকার নির্দলীয় ব্যবস্থা।

দেশের চার হাজার ৫৫৫টি ইউপির মধ্যে এবার ছয় ধাপে চার হাজার ৮৫ ইউপিতে ভোট হয়েছে।

এরমধ্যে গত ২২ মার্চ প্রথম ধাপে ৭১২ ইউপির, ৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপে ৬৩৯ ইউপির, ২৩ এপ্রিল তৃতীয় ধাপে ৬১৪ ইউপির, ৭ মে চতুর্থ ধাপে ৭০৩ ইউপির এবং ২৮ মে পঞ্চম ধাপে ৭১৭ ইউপির এবং সর্বশেষ ৪ জুন শনিবার ষষ্ঠ ও শেষ ধাপে ভোট হয় ৬৯৮ ইউপির।

অনিয়মের কারণে ৩৪৬টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হয়েছে। যার ফলে প্রায় অর্ধশত ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে পুনরায় ভোটের প্রয়োজন পড়বে।