জাপা মহাসচিব: এই আছে, এই নাই

যেভাবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব হয়েছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সেভাবেই সরতে হল তাকে। যাকে সরিয়ে তাকে আনা হয়েছিল এই পদে, ফিরেছেন সেই এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার।

সুমন মাহমুদও সালাহউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2016, 06:02 PM
Updated : 20 Jan 2016, 11:45 AM

১৯৮৬ সালে দল গঠনের পর থেকে এভাবেই মহাসচিব বদল হচ্ছে এইচ এম এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে।

হিসাব করলে দেখা যায়, বাবলুর আগ পর্যন্ত এই ৩০ বছরে প্রায় ডজন খানেক মহাসচিব পেয়েছে জাতীয় পার্টি। তাদের আসা-যাওয়া কোনো কাউন্সিল বা সম্মেলনে হয়নি, সব হয়েছে চেয়ারম্যান এরশাদের ইচ্ছায়।

সামরিক শাসক থেকে রাজনৈতিক দল গড়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এরশাদ ‘স্বৈরাচারী’ কায়দায়ই দল চালিয়ে আসছেন বলে জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে যাওয়া নেতাদের অভিযোগ।

এরশাদ নিজেও জাতীয় পার্টিকে ‘আমার দল’ বলে থাকেন। বাবলুকে সরানো এবং ভাই জি এম কাদেরকে কো চেয়ারম্যান করা নিয়ে চলমান দ্বন্দ্বের মধ্যেও তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “এটা আমার পার্টি।” 

এরশাদের এই দলটির মহাসচিবের দায়িত্বে থাকা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে মহাসচিব নির্বাচনের ক্ষমতা দলের চেয়ারম্যানকে দেওয়া রয়েছে।

“সেই অনুযায়ী প্রতিবার তিনি যাকে খুশি তাকেই মহাসচিব মনোনীত করেছেন। কোনোবারই কাউন্সিলের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে কাউকে মহাসচিব করা হয়নি।”

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জিয়াউর রহমানের মতো এরশাদেরও উত্থান পর্ব শুরু হয়। জিয়া রাষ্ট্রপতি হয়ে সেনাপ্রধান করেছিলেন একাত্তরে অস্পষ্ট ভূমিকায় থাকা এরশাদকে।

১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়ার মৃত্যুর পর তার পথ অনুসরণ করেই প্রথমে সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরে রাষ্ট্রপতি হন এরশাদ।

তাদের দুজনের ক্ষমতারোহনই বেআইনি ছিল বলে আদালতের রায় রয়েছে। জিয়া হত্যাকাণ্ডের এরশাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগও করেন বিএনপির অনেকে।

জিয়া যেভাবে জাগদলের পৃষ্ঠপোষকতার পর সামরিক শাসক থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই এরশাদ জনদলের পর জাতীয় পার্টি গঠন করেন।

ডা. এম এ মতিন

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন

১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠনের পর এর প্রথম মহাসচিব হন ডা. এম এ মতিন। জিয়া ও আব্দুস সাত্তারের সরকারের এই মন্ত্রী জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদে তিন বছর ছিলেন।

মতিনকে সরিয়ে এ পদে আসেন এডভোকেট মাহবুবুর রহমান, যিনি এর আগে এরশাদ ঘোষিত ১৮ দফা বাস্তবায়ন পরিষদের মহাসচিব ছিলেন। জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে ফিরে রাজনীতিতে এখন নিষ্ক্রিয় নোয়াখালীর চাটখিলের সাবেক এই সংসদ সদস্য।

মাহবুব অল্প কিছু দিন দায়িত্ব পালনের পর টাঙ্গাইলের মাহমুদুল হাসানকে মহাসচিব করেন এরশাদ। ব্যাপক মাত্রার দুর্নীতির অভিযোগ ছিল সাবেক এই মেজর জেনারেলের বিরুদ্ধে।

১৯৯০ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র হলে এরশাদ সেনা কর্মকর্তা মাহমুদুলকে সরিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হয়ে আসা শাহ মোয়াজ্জেমকে বসান মহাসচিব পদে।

কিন্তু ওই গণআন্দোলনে পতন ঘটে এরশাদের, কারাগারেও যেতে হয় তাকে। এর মধ্যেই ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মহাসচিব পদে ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম।

শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে বিএনপিতে ফিরে যান শাহ মোয়াজ্জেম, এখনও দলটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন তিনি।   

শাহ মোয়াজ্জেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতীয় পার্টি যারা গঠন করেছিল, আমি ছিলাম তাদের মধ্যে একজন।

“আমি যখন পার্টিতে ছিলাম, তখন বেশ কয়েকবার ওই ধারা (চেয়ারম্যানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা) পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি, লাভ হয়নি। আমার দল ছাড়ার অন্যতম কারণ ছিল এটা।”

খালেদুর রহমান টিটো

এরশাদ বন্দি থাকা অবস্থায় শাহ মোয়াজ্জেমকে সরিয়ে যশোরের খালেদুর রহমান টিটোকে মহাসচিব করেন। তিনি এই পদে দুই বছরও টেকেননি। আওয়ামী লীগ হয়ে এখন তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়।

১৯৯৫ সালে আবার কারাগার থেকে চিরকূট পাঠিয়ে টিটোকে বাতিল করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মহাসচিব করেন এরশাদ।

এর পরের বছর কারামুক্ত হন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত এই সামরিক শাসক। তার আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকারে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি, মন্ত্রী হন মঞ্জু।

কিন্তু ১৯৯৭ সালে এরশাদ সরকারে না থাকার সিদ্ধান্ত নিলে তাতে আপত্তি জানান মঞ্জু। তখন মঞ্জুকে মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

তবে মঞ্জু মন্ত্রী পদে থেকে যাওয়ার পাশাপাশি আলাদা জাতীয় পার্টি (জেপি) গঠন করেন। ওই দল থেকে এমপি হয়ে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারেও আছেন তিনি।

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

নাজিউর রহমান মঞ্জুর

মঞ্জুকে সরানোর পর নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে মহাসচিব পদে বসান এরশাদ। ভোলার এই এমপি এরশাদের আমলে ঢাকার মেয়র ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী থাকার সময় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।   

প্রায় তিন বছর পর ২০০১ সালে নির্বাচনের সময় বিএনপি-জামায়াত জোটে যোগ দেওয়া নিয়ে নানা নাটকীয় পরিস্থিতির পর মঞ্জুরকেও বাদ দেন এরশাদ।

মঞ্জুর মতো মঞ্জুরও তখন আলাদা দল গঠন করেন। তাতে সঙ্গী হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রথম মহাসচিব ডা. মতিনকে।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নামে ওই দলটি এখন মঞ্জুরের ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে রয়েছেন।

২০০১ সালে সাবেক জাসদ নেতা বগুড়ার এ বি এম শাহজাহানকে মহাসচিবের দায়িত্বে আনেন এরশাদ।

দুই বছর পর ২০০৩ সালে এ পদে আসেন বরিশালের রুহুল আমিন হাওলাদার। এরশাদের সব কথা বিনা প্রশ্নে মেনে চলা হাওলাদার টানা ১২ বছর এই দায়িত্বে ছিলেন।

জিয়াউদ্দিন বাবলু

রুহুল আমিন হাওলাদার

দশম সংসদ নির্বাচনে নাটকীয়ভাবে অংশগ্রহণের পর ২০১৪ সালে হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব করেন এরশাদ।

শেখ হাসিনার এই সরকারে মন্ত্রী হওয়া আনিসুল ইসলাম মাহমুদের মতো বাবলুও আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত। দলের কর্মীরা বলেন, এরশাদের পরিবর্তে তার স্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের দিকেই ঝুঁকে আছেন বাবলু।  

রোববার রংপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এরশাদ ভাই জি এম কাদেরকে কো চেয়ারম্যান ঘোষণার পাল্টা এক ঘোষণায় রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার কথা জানিয়েছিলেন বাবলু।

মঙ্গলবার ঢাকায় ফিরে সংবাদ সম্মেলন করে বাবলুকে সরানোর ঘোষণা দেন এরশাদ। সেই সঙ্গে জানান, হাওলাদারকে ওই পদে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি।

গত শতকের ৮০ এর দশকের বামপন্থি ছাত্রনেতা বাবলু ডাকসুর জিএস থাকা অবস্থায় এরশাদের দলে যোগ দিয়ে তার শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হন। পরে তাকে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও দেওয়া হয়। এজন্য তাকে ‘বেঈমান’ বলেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা।

সেই বাবলুকে মহাসচিব পদ থেকে সরানোয় দলের মধ্যে যারা আপত্তি তুলেছেন, তাদের নিজের ইচ্ছাধীনে মহাসচিব পদ পরিবর্তনের আগের নজিরগুলোই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এরশাদ।

“রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব করেছি। তখন তো কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেননি। এখন প্রশ্ন তুলছেন কেন?”