গত কয়েক বছরে নানা নাটকীয়তার জন্ম দেওয়া সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ রোববার নিজের জেলা রংপুরে সংবাদ সম্মেলন করে ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ও উত্তরসূরি ঘোষণা করেন।
এরপর সোমবার রাতে ঢাকায় পার্টির সরকার সমর্থক সাংসদ ও সভাপতিমণ্ডলীর নেতাদের একাংশের 'যৌথ সভা' থেকে এরশাদের সিদ্ধান্তকে ‘গঠনতন্ত্রবহির্ভূত’ ঘোষণা হয়। সেইসঙ্গে এরশাদের স্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতা রওশনকে দলের ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন’ করা হয়েছে বলে জানান পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।
এর মধ্য দিয়ে ১৯৮৬ সালে যাত্রা শুরু করা এই দলটিতে নতুন করে ভাঙনের গুঞ্জন শুরু হয়।
রওশনের বাড়ির ওই বৈঠকের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রংপুরে অবস্থানরত এরশাদ তার প্রতিক্রিয়া জানাতে একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে ডেকে বলেন, “আমিই পার্টির চেয়ারম্যান। সভাপতিমণ্ডলীর সভা আহ্বান করার এখতিয়ার শুধু আমার। আমি ছাড়া সভাপতিমণ্ডলীর কোনো সভা কেউ ডাকতে পারেন না।
“ডাকলেও তা হবে গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। রওশন এরশাদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করাটাও অবৈধ। যারা করেছে তাদের উদ্দেশ্য অসৎ।”
জাতীয় পার্টিকে ভাঙার চেষ্টা চলছে দাবি করে এজন্য দলের আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ নেতাদের দিকেও অভিযোগের আঙুল তোলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ।
বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে চলতি সংসদের নবম অধিবেশন সামনে রেখে বিকাল সাড়ে ৩টায় জাতীয় সংসদ ভবনে বৈঠকে বসছে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল। বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ ওই সভায় সভাপতিত্ব করবেন বলে দলীয় নেতারা জানিয়েছেন।
দুই বছর আগে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে এরশাদ ও রওশনের মধ্যে টানাপড়েন দেখা দেয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে দুজনের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই এরশাদ বলেছিলেন, রওশনই তার কাণ্ডারি।
বিএনপিবিহীন দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নাটকীয় অংশগ্রহণের পর এরশাদের দল বিরোধী দলের আসনে বসার পাশাপাশি সরকারেও অংশ নেয়। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ মন্ত্রী এবং মশিউর রহমান রাঙ্গা প্রতিমন্ত্রী হন। এরশাদ পান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব, তার স্ত্রী হন বিরোধী দলীয় নেতা।
একটি দলের একইসঙ্গে দুই ভূমিকায় থাকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে; জাতীয় পার্টি সত্যিকার অর্থে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে কি না- উঠেছে সে প্রশ্নও। এরশাদ নিজেও বিভিন্ন সময়ে সরকার থেকে সরে আসার কথা বলেছেন; তবে রওশনপন্থিরা তাতে রাজি নন।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অফ আর্মি স্টাফ থাকা অবস্থায় ক্ষমতা নিয়ে ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে দেশ শাসন করেন এরশাদ। পরে বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ করে নিজেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করেন। শুরু থেকেই তিনি দলের চেয়ারম্যান।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত চারবার ভেঙেছে জাতীয় পার্টি।
১৯৯৭ সালে এরশাদ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়ায় তার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ আলাদা হয়ে গিয়ে জাতীয় পার্টি (জাফর-মোয়াজ্জেম) গঠন করেন। অবশ্য বছর খানেক পর আবার এরশাদের দলে ফেরেন জাফর।
আর এরশাদ বিএনপির সঙ্গে জোট করায় ১৯৯৯ সালে পার্টির তখনকার মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বেরিয়ে যান, গঠন করেন আলাদা জাতীয় পার্টি (জেপি)।
এরশাদ ২০০০ সালে বিএনপির জোট ছাড়লেও জাতীয় পার্টির একাংশ বিজেপি (নাজিউর মঞ্জু) নামে জোটে থেকে যায়।
২০১৩ সালে কাজী জাফর পার্টি বহিষ্কৃত হয়ে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন, তৈরি হয় জাতীয় পার্টি (জাফর)। তিনিও বিএনপির সঙ্গে জোটে আছেন।
আগামী মার্চে জাতীয় পার্টির ত্রিবার্ষিক সম্মেলন সামনে রেখে যখন নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তখনই আবার নতুন সঙ্কটে পড়ল দলটি।