জানা পর্ব
ইসলামে বিবাহ বিচ্ছেদের কয়েকটি পদ্ধতি আছে যেমন বিভিন্ন পদ্ধতিতে স্ত্রীকে স্বামীর তালাক দেয়া বা স্ত্রী আদালতে আবেদন করে শারিয়ার "খুলা" আইনের মাধ্যমে সম্ভব হলে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর করা। পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলেমদের কিছুটা মতভেদ আছে, কিন্তু এ নিবন্ধের বিষয় হল চূড়ান্ত বিবাহ-বিচ্ছেদের পর একই স্বামী স্ত্রীর পরষ্পরের সাথে পুনর্বিবাহ। এরকমটা ঘটে বাস্তবে। অনেক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিবাহ-বিচ্ছেদের পর স্বামী-স্ত্রী মনে করেন তালাকের সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল, সংসারটা চালিয়ে যাওয়াই ভালো। তাছাড়া বাচ্চাকাচ্চা থাকলে তো তাদের জন্য এর বিকল্প নেই, বাচ্চাদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য বাবা মা দুজনই দরকার। তখন তাদের পুনর্বিবাহের জন্য বিশ্ব-মুসলিম অতীত বর্তমানে মেনে চলেছে সংশ্লিষ্ট শারিয়া আইন যা বানানো হয়েছে সূরা বাকারা আয়াত ২২৯ ও ২৩০-এর ভিত্তিতে। সংশ্লিষ্ট অংশ তুলে দিচ্ছি :
"তালাক দু'বার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে… যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে এরপর সেই পুরুষের পক্ষে সেই স্ত্রী হালাল হবেনা যে পর্যন্ত না সে অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে। অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয়, তবে উভয়ের পুনরায় মিলিত হওয়াতে গুনাহ নেই"।
অর্থাৎ তালাক পুরো হয়ে গেলে তারা সরাসরি পরষ্পরকে আবার বিয়ে করতে পারবে না, স্ত্রীকে অন্যত্র বিয়ে করতে হবে। এটাই আমরা জানি, এটাই প্রচলিত। কিন্তু ঠিক কি চরিত্রের স্বামীর কোন সে ঘটনায় বাকারা আয়াত ২২৯ নাজিল হয়েছিল? ইরানের নিশাপুরে ১০০০ সালের দিকে জন্মেছিলেন বিখ্যাত ইমাম আল ওয়াহিদি, তার সুবিখ্যাত কেতাব "আসবাব আল নুজুল" ("আয়াত নাজিলের শ্রেষ্ঠ বিবরণ") ইসলামে দলিলের এক অনন্য নির্ভরযোগ্য কেতাব যাতে কোরানের অনেক আয়াতের পটভূমি ধরা আছে। সংক্ষেপে কেতাবের ২৩ পৃষ্ঠা থেকে সূরা বাকারা আয়াত ২২৯-এর পটভূমি তুলে দিচ্ছি। ইসলামে "ইদ্দত" হল অন্যত্র বিয়ের আগে স্ত্রীর অপেক্ষা-কাল, সাধারণত তিন মাসিক।
"(বর্ণনাকারী অনেক সাহাবীদের সনদ) বলিয়াছেন, 'ইহাই প্রচলিত ছিল যে, স্ত্রীকে তালাক দিবার পর ইদ্দত শেষ হইবার পূর্বে স্বামী তাহাকে ফিরাইয়া লইতে পারিত, হাজার বার তালাক দিলেও (অর্থাৎ যতবার ইচ্ছা – লেখক)। এক বিশেষ সাহাবী (কেতাবে সাহাবীর নাম নেই – লেখক) তাহার স্ত্রীকে তালাক দিল এবং ইদ্দত শেষ হইবার ঠিক আগে তাহাকে ফিরাইয়া লইল। ইহার পরপরই সে আবার স্ত্রীকে তালাক দিল এবং বলিল – 'আল্লাহ'র কসম! আমি তোমাকে ফিরাইয়াও লইব না এবং কখনোই অন্য কাহাকে বিবাহ করিতেও দিবনা'। তখন মহান আল্লাহ নাজিল করিলেন – 'তালাক উচ্চারণ অবশ্যই দুইবার; ইহার পর তাহাকে সম্মানের সহিত রাখিবে কিংবা সদয়ভাবে মুক্ত করিতে হইবে' (মাস্ট বি রিটেইন্ড ইন অনার অর রিলিজড ইন কাইন্ডনেস)"।
অর্থাৎ তালাক-বিয়ের চক্র দুই বারের বেশি করা যাবেনা। এই হুকুম প্রসারিত হয়েছে পরের আয়াতেই- সেই স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করে সেখান থেকে বিধিমতো তালাক বা সেই স্বামীর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আগের অত্যাচারী স্বামীর বিন্দুমাত্র অধিকার নেই তাকে আবার বিয়ে করার, তাও আবার নারীর সম্মতিক্রমে (আয়াত ২৩০)।
অর্থাৎ স্ত্রীদের সম্মান, অধিকার ও জীবন নিয়ে অত্যাচারী স্বামীদের শতাব্দী প্রাচীন ইঁদুর-বেড়াল খেলার কুপ্রথাকে কোরান বজ্রাঘাতে উচ্ছেদ করেছে। আমি বুঝতে অক্ষম যারা কোরানকে নারী-বিরোধী বলেন তাঁরা কেন এই দলিলগুলো উল্লেখ করেন না। অন্যদিকে, আয়াতটা অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে নারীর রক্ষাকবচ কিন্তু ওটা প্রয়োগ হয়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে, এমনকি প্রেমময় স্বামীর ক্ষেত্রেও।
আয়াত ২২৯ ও ২৩০ এই যে – "যে পর্যন্ত না সে অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে"- নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল অন্য কাউকে বিয়ে করার বা না করার। কিন্তু কয়েক দশক আগেও এর বর্বর প্রয়োগ আমরা দেখেছি তালাকের পর হিল্লা বিয়ের নামে নারীকে জোর করে অন্যের সাথে বিয়ে দিয়ে তার বিছানায় পাঠানো হত। এটা ইসলামের নামে 'ধর্ষণ' ছাড়া আর কিছুই নয়। সুখের বিষয় অনেক আলেম এ বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে শক্তিশালীভাবে দাঁড়ানোর ফলে ধীরে ধীরে এটা মোটামুটি উচ্ছেদ হয়েছে। আগের প্রজন্মরা যেটা ইসলামী মনে করে প্রয়োগ করতো, বর্তমান প্রজন্ম বুঝে গেছে আসলে ওটা ইসলামী নয়। সমাজ এভাবেই এগোয়।
অজানা পর্ব
অতীত বর্তমানের বেশ কিছু স্কলার ও আলেমদের এখানে ওখানে প্রকাশিত কিছু বিচ্ছিন্ন নিবন্ধে এটা আমি পড়েছি। কিন্তু এ ব্যাপারে গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়নি, গণমানসে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেটাই তুলে ধরছি মাত্র, এর বেশি কিছু বলার অধিকার আমার নেই। সূরা বাকারা আয়াত ২৩২:
"যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও, তারপর তাদের ইদ্দৎ পূর্ণ হয়ে যায়, সে অবস্থায় তারা স্বামীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে তাদেরকে বাধা দিও না যখন তারা বৈধভাবে উভয়ে আপোষে সম্মত হয়"- তাইসিরুল কুরআন।
(Emphasis mine).
কী দাঁড়ালো তাহলে?
কোন ঘটনায় নাজিল হয়েছিল সূরা বাকারা আয়াত ২৩২? সংক্ষেপে তুলে ধরছি "আসবাব আল নুজুল" কেতাব থেকে, পৃষ্ঠা ২৪: –
সাহাবী মাকাল বিন ইয়াসার তার বোনকে তার কাজিনের সাথে বিয়ে দিল, যে স্বামী পরে সেই স্ত্রীকে তালাক দিল। তারপরে তারা আবার বিয়ে করতে চাইলে ক্রুদ্ধ মাকাল তাতে প্রচণ্ড বাধা দিল। তখন এই আয়াত নাজিল হয়, "যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এবং তারপর তারাও নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ণ করে, তখন তাদেরকে পূর্ব স্বামীদের সাথে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী বিয়ে করতে বাধাদান করো না"। আয়াত নাজিলের পরে মাকাল সম্মত হয় ও আবার তাদের বিয়ে হয়।
তাহলে?
মুদ্রার দুই পিঠই দেখানো হল। এখন যে যার সিদ্ধান্ত নিক।
শৈশবে আপনার বাবা-মা'র সংসার ভেঙে গেলে আপনার কেমন লাগত? কিভাবে বড়ো হতেন?
গত মাসে স্ত্রীর সাথে আবদুল্লা-র বিধি মোতাবেক পুরো তালাক হয়ে গেছে, এখন ওরা আবার সংসার করতে চায়। ওদের চার বছরের একটা ছেলে আর দু'বছরের একটা মেয়ে আছে। ওই নিষ্পাপ শিশুদুটোর চোখের দিকে তাকান। কী মনে হয়?
"দুইটি প্রেমময় হৃদয়ের মধ্যে বিবাহ হইতে উত্তম আমি আর কিছু দেখি না" – সহি ইবনে মাজাহ, ৩য় খণ্ড হাদিস ১৮৪৭। রহমাতুল্লিল আল আমিন যদি হতে হয় তবে সেটা এই, সেটা এইখানে। ভ্রান্তিময় মানুষ ভুল করতেই পারে কিন্তু অনুতাপের পরে স্বামী স্ত্রী, বাচ্চাদের জীবন ধ্বংস হবে কেন?
"…তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ্ তাই চান ও তোমাদের পক্ষে যা কষ্টকর তা তিনি চান না … দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নি" – সূরা বাকারা ১৮৫ ও হজ্ব ৭৮।
সবাইকে সালাম।