সাঁথিয়ার হিন্দু পল্লীতে আতঙ্ক

সাহাপাড়া গ্রামে নিজেদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝে নিজের পানির মগ, প্লাস্টিকের চেয়ার ও টেলিভিশনের  ধ্বংসাবশেষ দেখে ক্রোধে ফুঁসে ওঠে পাঁচ বছরের মেয়ে অর্ঘ।

সাঁথিয়া থেকে সালিম সামাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2013, 09:41 AM
Updated : 11 Nov 2013, 10:22 AM

এর জন্য গত ২ নভেম্বর কালী পূজার দিনে সহিংসতা চালিয়ে যাওয়া ‘দুষ্টু ছেলেদের’ দায়ী করে সে।

তবে ওই তাণ্ডবের কথা বলতে গিয়ে সতর্ক শিশুটির মা, সশস্ত্র উগ্র মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা পেতে দুর্গন্ধময় টয়লেটের মধ্যে তিন ঘণ্টা লুকিয়ে ছিলেন যিনি। তার ঘরের একটি অংশ ভেঙে চুরমার করেছে দুর্বৃত্তরা।

ওই হামলার অল্প কিছুক্ষণ আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সাঁথিয়ার বনগ্রামের মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে করমজাত মাদ্রাসায় একটি সমাবেশ করেন।

হযরত মোহাম্মদকে (স.) কটূক্তি করে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেয়ার গুজব ছড়িয়ে ওই হামলা হয়।

হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাহাপাড়া। কারণ রাজীব সাহা নামে যার বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ আনা হয় তিনি এই গ্রামের বাসিন্দা।

হামলার জন্য শনিবার হাটের দিনকে বেছে নেয় দুর্বৃত্তরা। সেদিন কথিত ওই ফেইসবুক পৃষ্ঠার শত শত ফটোকপি হাটে উপস্থিতদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এতে সব দলের মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারই জের ধরে চলে কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডব, যাতে অন্তত ৪০টি হিন্দু বাড়ি আক্রান্ত হয়।

হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক থাকায় এখনো ওই এলাকায় তরুণীরা বাড়ি ফিরে আসেনি। হামলায় জড়িতরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তাদের এ আতঙ্ক।

সবচেয়ে বড় আতঙ্কের কারণ হামলার উস্কানিদাতারা এখন স্থানীয় সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী টুকুসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছেন।

আক্রান্তদের কাছে এটাই সবচেয়ে বিস্ময় ও কষ্টের কারণ হয়েছে যে, যারা তাদের হামলা করেছে তারা কিভাবে আওয়ামী লীগ থেকে সুরক্ষা পায়।

এছাড়া এ ঘটনার জন্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টুকু দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক আবু সাঈদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে লেলিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

কিন্তু কথিত ফেইসবুক পোস্টের কী বৃত্তান্ত!

রামুর মতো বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ভুয়া ফেইসবুক পোস্টের গুজব তুলে যেভাবে মুসলমানদের উস্কে হিন্দুদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে ঠিক তেমনি রাজীব সাহার বিরুদ্ধে হযরত মোহাম্মদকে (স.) কটূক্তি করে ফেইসবুক পোস্ট দেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি বানোয়াট।

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, রাজীবের নামে যে ফেইসবুক পোস্টের ফটোকপি ছড়ানো হয়েছিল তা মূলত  ফটোশপের মাধ্যমে কারসাজি করা একটি ছবি ‘ইনোসেন্ট রাজীব’ নামের একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল।

ঘটনাটি অনেকটাই ছিল কক্সবাজারের রামুতে গত বছর সেপ্টেম্বরে সাম্প্রদায়িক হামলায় কয়েকশ’ বৌদ্ধ বাড়িতে হামলার ঘটনার মতো।

রামু ও সাঁথিয়া- দুটো ঘটনায়ই দুর্বৃত্তরা কোনো সময় নষ্ট করেনি। মিথ্যে অভিযোগ তুলে মুসলমানদের উস্কে দিয়ে তা কাজে লাগিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে।

পাবনার পুলিশ সুপার মিরাজুদ্দিন আহমেদ দুস্কৃতকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু হামলার দিন সকালে রাজীবের বাবা বাবুল সাহার সঙ্গে যারা কথা বলেছিলেন তারা ছাড়া হামলায় জড়িত কাউকে এখনো সনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

হামলার ষড়যন্ত্রকারীরা গ্রেপ্তার হয়েছে কি না জানতে চাইলে মামলার বাদি বাবুল সাহার উত্তর, ‘না’।

আতাইকুলা থানার ওসি রেজাউল করিম বলেন, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হামলার জন্য পুলিশের একটিসহ মোট তিনটি মামলা হয়েছে।

এ বিষয়ে পাবনার জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন বলেন, এটা পুলিশের ব্যাপার। এক্ষত্রে বেশ সন্তোষজনক অগ্রগতিও হয়েছে।

সহিংসতার পর ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা ছাড়া বেসামরিক প্রশাসনের কিছুই করার নেই বলে জানান তিনি।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তার জন্য জনপ্রতি ২৮ কেজি চাল দেয়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয় তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বনগ্রাম, সাহাপাড়া ও ঘোষপাড়ার ক্ষতিগ্রস্তরা।

রাজীবের চাচা কার্তিক সাহা বলেন, তাদের চালের দরকার নেই। দরকার নিরাপত্তার।

রামুতে যেভাবে সরকারি উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ মন্দির গড়ে তোলা হয় তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলোকে আবার  দাঁড় করাতে সরকারি সহায়তা চান সাঁথিয়ার হিন্দুরা।

ঘটনার পর থেকে সাঁথিয়ায় এক প্লাটুন র‌্যাব ও দুই প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতির কারণে ২ নভেম্বরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে মনে করেন পুলিশ সুপার।

ওই এলাকায় স্থায়ী একটি পুলিশ ফাঁড়ি করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

স্থানীয় সাংবাদিকদের অভিযোগ, প্রতিমন্ত্রী টুকু ১০ মিনিটের মধ্যে হামলার খবর পেলেও হিন্দুদের রক্ষায় তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নেননি।

বাবুল সাহার কাছ থেকে বেশ কয়েকবার ফোন যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর অল্প কয়েকজন পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হওয়ার তিন ঘণ্টা পর র‌্যাব ও বেশি সংখ্যক পুলিশ সেখানে যায় বলে ক্ষতিগ্রস্তরা দাবি করেন।

প্রবীণদের মধ্যে অধিকাংশই মনে করতে পারেন না যে, এর আগে কবে তারা গত ২ নভেম্বরের মতো নৃশংসতার শিকার হয়েছিলেন। অবশ্য কেউ কেউ এ প্রসঙ্গে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের ধ্বংসযজ্ঞের কথা স্মরণ করেন।

বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর পরিকল্পিত যেসব হামলা হয়েছে সেগুলোর মতো এখানেও সংখ্যালঘুদের মনোবল ভাঙতে তাদের উপসনালয়ে হামলা চালানো হয়।

খাগড়াছড়ির তান্দং, কক্সবাজারের রামু ও উখিয়া, সাতক্ষীরা, বেগমগঞ্জ, গাইবান্ধা, লালমনিরহাটসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রায় একই ধরনের হামলা হয়।