জামায়াতে ইসলামী আগাগোড়াই একটি অবৈধ সংগঠন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেওয়ার পর থেকে দেশজুড়ে অনেকদিন জামায়াতের সহিংসতা চলেছে। তারা আমাদের যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নানা ধরনের নাশকতা চালিয়েছে। আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে ও জনমনে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে। পুলিশ সদস্যদের পর্যন্ত হত্যা করেছে। একটি দেশে এমন অরাজকতা চলতে পারে না।

. মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2013, 01:01 PM
Updated : 25 March 2013, 00:31 AM

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী একটি দল এভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার রাখে না। আমি বলব, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরেই দলটি এ অধিকার হারিয়েছে। ওইদিন পাকিস্তানি বাহিনি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল এটা আমরা জানি। কিন্তু এটা অনেকেই খেয়াল করেন না যে, আত্মসমর্পণের দলিলে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, পাকিস্তানি বাহিনি তার সব অক্সিলারি ফোর্সসহ আত্মসমর্পণ করছে। এখানে অক্সিলারি ফোর্স বলতে বোঝানো হচ্ছে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনিকে। এ তিন বাহিনির পিতৃসংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীও তখন থেকেই এদেশে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার হারিয়েছে। একে আরও জোরালো করার জন্য বাহাত্তরের সংবিধানের আর্টিকেল ৩৮-য়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মের নামে সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ।

এসব আইনগত দিক ছাড়াও বাস্তব অবস্থার দিক থেকে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করতে দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তাদের অনেক নেতা তখন জেলে ও আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলেও, দেশের বাইরে থেকে কেউ কেউ তখনও বাংলাদেশবিরোধী নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক তৎপরতা বৈধ করে দেওয়া হল। এর ফলে নানা সমঝোতার মাধ্যমে জামায়াত আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেল। জিয়াউর রহমান এ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

এ জন্যই পরে আমরা দেখেছি যে, জিয়াউর রহমানের এ ব্যবস্থা বৈধ ছিল কিনা সেটা কোর্টে উপস্থাপন করা হলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট একে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এ মর্মে রায় দেন যে, সংশোধনীটি ছিল অবৈধ। শুধু তাই নয়, এ সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত সব পদক্ষেপ অবৈধ হয়ে যায়। রায়ে আরও বলা হয় যে, বাহাত্তরের সংবিধানের ধারাগুলোতে আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

তাতে অবস্থাটা এই দাঁড়াল যে, কার্যত আর্টিকেল ৩৮ পুনঃপ্রবর্তিত হল। এ রায়ের পর আইনমন্ত্রী তাই জনসমক্ষে বলেছিলেন যে, এ রায়ের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু বাস্তবে কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, বাহাত্তরের সংবিধানে আর্টিকেল ৩৮-য়ের যে বয়ানটি ছিল সেটিকে হুবহু সংবিধানে না ঢুকিয়ে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তাতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হল। এটা এমনভাবে করা হল যে, এর ফলে বাহাত্তরের সংবিধানের অধীন জামায়াতে ইসলামী যেমন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল- এখন আর সেটা রইল না।

ওই অর্থে এটাই সত্য যে, জামায়াতে ইসলামীকে একবার বৈধতা দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান; আরেকবার একে বৈধ করলেন মহাজোট সরকার। কিন্তু কোর্ট আমাদের জানিয়েছেন যে, ওইভাবে এদের বৈধতা দেওয়া যায় না। প্রথমবার জানিয়েছেন এভাবে যে, পঞ্চম সংশোধনী বৈধ ছিল না। দ্বিতীয়বার, যদিও এটা কোর্টে উত্থাপিত হয়নি, তবে হলেও এটা বোঝা যায় যে, রায় একই পাওয়া যেত- আর তা হল, রাষ্ট্রের অন্যতম আদর্শ বা মূলনীতি যদি হয় ধর্মনিরপেক্ষতা- তাহলে বাহাত্তরের আর্টিকেল ৩৮-এ হাত দেওয়া যায় না।

এ জন্যই আমি বলব, জামায়াতে ইসলামী আগাগোড়াই একটি অবৈধ সংগঠন- সেই একাত্তর সাল থেকেই। একে যে বৈধতা দেওয়া হয়েছে সেটা প্রথমবারও ছিল অবৈধ, দ্বিতীয়বারও তাই।

অন্য আরেকটি দিক থেকে আমি মনে করি জামায়াত অবৈধ একটি সংগঠন। বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, যেসব সংগঠন গণহত্যা পরিচালনা করেছিল সেগুলো যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য হযেছে। আর প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী কোনো সংগঠন এমনিতেই অবৈধ হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জার্মানিতে নাজি পার্টিকে এবং বর্ণবাদী কাজকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান নামের একটি পার্টিকে অনন্তকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সন্ত্রাসী কাজকর্ম পরিচালনার জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ হয়েছে হিজবুত তাহরির ও হরকাতুল জিহাদের মতো সংগঠন।

সর্বশেষ যে যুক্তি আমি দেব তা হল, জামায়াতে ইসলামী কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। যদি আল কায়েদা বা তালেবানের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়, তবে জামায়াতকেও করা উচিত। কারণ তারাও একই ধরনের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।

অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই যে, জামায়াতের মতো একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে কথা বলছে পশ্চিমা বিশ্ব। তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মতো অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনোরকম নীতি-নৈতিকতার ধার ধারে না। নিজেদের যখন যেভাবে সুবিধা সেভাবে নৈতিকতার কথা বলে।

সাম্রাজ্যবাদীদের এ ধরনের সুবিধাবাদী নৈতিকতা আমাদের মেনে নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। একটি দেশ কীভাবে চলবে, জাতীয় পর্যাযে কী কী পদক্ষেপ নেবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার চূড়ান্ত বিচারে সে দেশের জনগণের। সম্প্রতি শাহবাগের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের জনগণ রায় দিয়েছে যে, জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন বলে এদেশে এদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। পাশাপাশি, ওই সংগঠনটি সাম্প্রতিককালে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য যে সহিংসতা ও তাণ্ডব চালাচ্ছে- রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে বৈধ একটি ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে এবং এভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা করছে- এসবের বিচারেও এদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে জামায়াত গত কয়েক দশকে কেন এভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? আমাদের রাজনীতিবিদরাই-বা কেন দলমত নির্বিশেষে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে শক্তিশালী করে তুলেছেন? এর জন্য আমি মূলত দায়ী করব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে। ওরা জামায়াতকে বরাবরই একটি মডারেট ইসলামিক দল হিসেবে চিহ্নিত করে এ দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ওরা জামায়াতের সঙ্গে সহাবস্থানের সিদ্ধান্তও চাপিয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত জামায়াতের সঙ্গে সংলাপে বসার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। এ কথা শুনে আমার মনে পড়ল, একাত্তরে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম চলার সময় যুক্তরাষ্ট্র হুবহু একই ভাষায় কথা বলেছে- তারা আমাদের বলেছে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসে রাজনৈতিকভাবে সংকটের সমাধান করতে!

আমাদের প্রধান দলগুলো মূলত রাজনীতি করার সুবিধার্থে যুক্তরাষ্ট্রকে চটাতে চায় না। কারণ তাহলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না বলে ভয় পায়। আর এ জন্যই বড় দলগুলো জামায়াতের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে একে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ওদের কোলে টেনে নিয়েছে। আর আওয়ামী লীগ সবসময় চেষ্টা করেছে জামায়াতকে নিজেদের কাছে টানতে না পারলেও, যেন বিএনপির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়।

দু’দলের এ ধরনের আত্মঘাতী কৌশলের ফলে জামায়াত বস্তুত, বিএনপির কাঁধে ভর করে আমাদের রাজনীতিতে জায়েজ হয়েছে। আর কৌশলগত ঐক্যের নামে আওয়ামী লীগ ওদের সঙ্গে সংলাপ করে ওদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে দিয়েছে।

রাজনীতিতে এভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পর জামায়াত প্রয়োজনমতো নিজেদের বিকাশ ঘটিয়েছে। গত জোট সরকারের আমলে জামায়াত প্রশাসনের মাধ্যমে সমাজে গভীরভা্বে অনুপ্রবেশ করেছে। ওই দলের দুজন তখন খালেদা জিয়া সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামায়াত ওই দুটি মন্ত্রণালয়ে তাদের লোকজনকে নিয়োগ দিয়েছে। ওদিকে বৈধভাবে রাজনীতি করার সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই জামায়াত একটি বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, বছরে যেখান থেকে রিটার্ন আসে ১২ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ দিয়ে এরা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। হাজার কোটি ডলার খরচ করে এরা আন্তর্জাতিক লবিংকে নিজেদের অনুকূলে ব্যবহার করেছে, করে যাচ্ছে।

এমন একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই আমাদের তারুণ্য হাল ধরেছে। ক’দিন আগেও অনেকেই বলত যে, এখনকার তারুণ্য অতীতের দিকে তাকাতে চায় না, কারণ তাতে জাতি বিভক্ত হয়ে যাবে। এ ধরনের প্রতিটি কথা মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয়েছে। শাহবাগে সমবেত হয়ে তরুণরা বলে দিয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে যাবে। কারণ এ তরুণরাই একদিন বয়োজ্যেষ্ঠ হবে। এভাবে জনগণের কণ্ঠ সোচ্চার থাকলে একাত্তরের ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের প্রাপ্য সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের অনেক দেশ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে। তাদের উদ্দেশে বলব- গণহত্যার অপরাধের মাত্রা ভিন্ন। আর তাই এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হতে হবে। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আমার প্রশ্ন- যখন ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেওয়া হল তখন কোথায় ছিল তাদের মানবাধিকার?

জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বাঁচাতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল চিৎকার-চেঁচামেচি করছে- আমি জানতে চাইব, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যা করার সময় ওরা কোথায় ছিল? টু শব্দটি করেনি তখন। বরং আমরা দেশটাকে স্বাধীন করে ফেলার পর বন্দী পাকসেনাদের মানবাধিকার রক্ষার্থে বাংলাদেশে একটি মিশন পাঠিয়েছিল!

সাম্রাজ্যবাদীদের অতীতের এসব ভ্রান্তি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড বলে দেয় যে, যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত প্রসঙ্গে তারা এ ধরনের ভূমিকাই সবসময় পালন করবে। আফগানিস্তানের তালেবানরাও তাদেরই সৃষ্টি। তাদের মদদে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেই তালেবানরা তখনকার আফগান প্রেসিডেন্ট বাবরাক কারমালকে কাবুলের জাতিসংঘ ভবন থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল! কোনো বিচারপ্রক্রিয়ার ধার ধারেনি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তৈরি তালেবানরা।

তাই আমরা মনে করি, আমাদের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে আগামীতে এ দেশে জামায়াতের রাজনীতি করার সুযোগ কতটুকু থাকবে কী থাকবে না। সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের আইনে কিছু পরিবর্তন আনার ফলে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে অভিযোগের কাঠগড়ায দাঁড় করানোর যে সুযোগ তৈরি হয়েছে- এর ফলে এ দলের নেতারা সরাসরি গণহত্যা পরিচালনার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। আর তাতে জাতিও দায়মুক্ত হবে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।