শাহবাগ ২০১৩: বেহাত আশা পুনর্দখলের ইতিহাস

কিন্তু আমরা দেখি আশা দুই প্রকারের। একধরনের আশা ছেলেভুলানো ছড়ার মতো পরাজয়ের অপরিসীম গ্লানি ভুলিয়ে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখে, সান্ত্বনার প্রলেপ দেয় কেবল। আরেক ধরনের আশা পরিবর্তনের পথে চালায়, মুক্তির স্বপ্ন দেখায়। ছেলেভুলানো আশার প্রলোভন উপেক্ষা করে তলানিতে এসে ঠেকা প্রত্যয়ীর এ আশা বহুমুখ থেকে এসে আজ শাহবাগে জড়ো হয়েছে। গ্রামশি এ আশার কথাই বলেছিলেন।

নাসরিন খন্দকার : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2013, 07:53 AM
Updated : 12 Feb 2013, 07:55 AM

কসাই কাদের মোল্লা নামে যার পরিচয়, গণহত্যা-ধর্ষণে যার অভিযোগ প্রমাণিত, তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ঘোষণায় মনের তীব্র হতাশা থেকে উঠে আসা প্রতিবাদে লাখো মানুষের এ গণজাগরণ প্রমাণ করে, আমরা আশা করেছিলাম। আমরা আশায় ছিলাম যে, একদিন এ রাজাকারদের বিচার হবে। ভাবতে অবাক লাগে, এ নিদারুণ নৈরাশ্যের দিনেও এ ’আশা’ কীভাবে, কী শক্তিতে টিকে ছিল এতদিন? যেখানে প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী ও বাংলাদেশের বিরোধীতাকারীরাও স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রীত্ত্ব করেন দিনের পর দিন, যেখানে একটু একটু করে আমাদের সব প্রতিষ্ঠান জামায়াত-শিবিরের দ্বারা দখল হতে থাকে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা নিয়ে টানাহেঁচড়া করা বড় বড় রাজনৈতিক দল ধর্ষক-খুনী-রাজাকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভেল্কিবাজি দেখান, যেখানে শ্রমিকরা নিয়মিত পোকামাকড়ের মতো পুড়ে মরেন, নিরীহ পথচারীকে ক্ষমতাসীনরা চোখের সামনে পিটিয়ে মেরে ফেলে, যেখানে নিয়মিত ক্রসফায়ারের নামে বিচারের বাইরেই যে কাউকে যে কোনো সময় মেরে ফেলা হচ্ছে, যেখানে আমাদের আশা ভোটের অঙ্কে কিনে নিয়ে ক্ষমতাসীনরা তাদের গদি সামলাতে ব্যস্ত থাকেন আর সবকিছু সহ্য করে আমরা আমাদের বেহাত হয়ে যাওয়া আশার কথা ভুলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকি আমাদের গর্তে- সেখানে কী যাদুবলে একটি রায়ে এমন তীব্র আশা আর পরিবর্তনের প্রত্যয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ হলাম?

এর উত্তর হল, শাহবাগের লাখো মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত ঘৃণা আর প্রতিবাদ এ নৈরাশ্যের দেশে এক নতুন প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিল। এ যাদুর নাম, এ প্রাণের নাম ’আশা’। এ আশার জননীর নাম জাহানারা ইমাম। তিনি যে আশা দেখিয়েছিলেন, আজ শাহবাগ তার হাত থেকে বেহাত হওয়া আশার পুনর্দখল করেছে।

শাহবাগ আজ দেখিয়ে দিয়েছে, প্রতিরোধের রাজনীতি কোনো দল বা মতের একার সম্পত্তি নয়। শুধু শাহবাগের কেন্দ্রীয় মঞ্চ বা কোনো একক নেতা নয়, মানুষের স্রোতের মাঝে বুকে ঝোলানো ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বা একপ্রান্তে আল্পনা এঁকে গোল হয়ে বসা একদল তরুণ কিংবা সন্তানকে কোলে আর হাতে ধরে আনা গৃহবধু, সবাই এ গণজাগরণের মালিক। ’জয় বাংলা’ স্লোগান আজ শুধু আওয়ামী লীগের নয়, শুধু বাঙালিরও নয়, এটি বাংলা অঞ্চলের সব ভাষা-ভাষী, সব সংস্কৃতির মানুষের। আজ এসেছে তারা এর পুনর্দখল নিতে। এ গণজাগরণে আজ ’আমরা সবাই রাজা’ সত্যিকার বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের শর্তে এসে মিলেছি। বহুবর্ণের রক্ত আজ এক সুতায় গাঁথা মালা। শুধুমাত্র নির্বাচনকেন্দ্রিক ও দু’দলের রাজনীতির খাঁচায় বন্দী গণতন্ত্র আজ মুক্ত হয়ে উঠেছে বহুদল, বহুমত, বহুমন আর বহুচেতনার এক মিলিত আশার ঐক্যস্থলে।

একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার যে চেতনা থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, লাখো শহীদ আর বীরাঙ্গনার জীবনের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সে সূচনা হলেও দু’দলীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচে ওইসব যুদ্ধাপরাধীরা যখন একটু একটু করে দখল করে নিচ্ছিল আমাদের সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি, তখন আমাদের শেষ ভরসা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। জনগণ এবার আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল এ ভরসাতেই। কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ে তাদের সে ভরসা আজ চলে গেছে। তাই তারা আজ জেগে উঠেছে জনতার গণতান্ত্রিক ক্ষমতা পুনর্দখল করতে। কেননা গণতান্ত্রিক দেশে জনতার দাবিই সর্বোচ্চ আদালত। জনতাই তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে সংসদে পাঠায়, তারাই আইন প্রণয়ন করে। ফলে তাদের বেইমানিতে জনতা যে জেগে উঠবে, কৈফিয়ত চাইবে, তার নমুনা এ গণজাগরণ।

এ গণজাগরণ আর প্রত্যয়ী প্রতিবাদ শাসকের গদি নড়িয়ে দিতে পারে, পারে তাদের সাজানো নাটকের প্লট ভেস্তে দিতে, পারে তাদের দুর্নীতি আর অনাচারের খুঁটি নাড়িয়ে দিতে। যে প্রত্যয় আজ শাহবাগের হাজারও তরুণ প্রাণের চোখেমুখে, একে তাই তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবেই। আবারও তারা আসবে পরিবর্তনের প্রত্যয়ী আশাবাদকে ছেলেভুলানো আশায় পাল্টে দিতে। দাবি মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতির মোয়া হাতে নিয়ে। প্রশ্ন এখন, আমরা কি আবারও কোনো বেইমানের হাতে আমাদের আশাপূরণের দায়িত্ব দিয়ে ঘুমাতে যাব? নাকি জননী জাহানারা ইমামের জাগানো আমাদের প্রাণের সে আশার দেখভালের ভার আমরাই নেব? আজ তাই আশায় বুক বাঁধার দিন, আশার চুরি ঠেকানোর দিন। আমাদের সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণই পারে একে ঠেকাতে।

এ বিয়াল্লিশ বছরে আমরা লাখো বীরাঙ্গনাকে ভুলে যেতে দিয়েছি। তাদের গ্লানিময় জীবনযাপনে বাধ্য করেছি। আর অন্যদিকে তাদের জীবন ধ্বংস করা রাজাকাররা বুক ফুলিয়ে বহাল তবিয়তে থেকেছে। গণহত্যা আর ধর্ষণের পরেও ছাড় পেয়ে পেয়ে এরা এ সমাজে অনাচারের বীজ বপন করেছে। বীজটি এখন মহীরুহ হয়ে উঠেছে। একে উপড়ে ফেলতে না পারলে ধর্ষণ আর হত্যার সংস্কৃতি আমরা কখনওই মোকাবেলা করতে পারব না। আজ জেগে ওঠা তরুণ প্রাণ এসেছে অনাচারের মহীরুহ উপড়ে ফেলে প্রতিবাদের সংস্কৃতি তৈরি করতে। তাই গণজাগরণ মঞ্চ হোক সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কেন্দ্র।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দিয়ে শুরু হোক এবার প্রতিরোধের সূচনা। শাহবাগ ২০১৩ তে রচিত হোক বেহাত আশা পুনর্দখলের ইতিহাস।