Published : 27 Aug 2010, 08:21 PM
আমাদের দেশে অনেক এলাকায় এখন সারা বছর ধানের আবাদ হয়। শস্য মৌসুমের সাথে তেমন কোন সম্পর্ক নেই। একবার ফসল কেটে সঙ্গে সঙ্গে জমিতে আবার রোপন করা হচ্ছে। এভাবে বছরে একই জমিতে তিন বার ধানের আবাদ হচ্ছে। তবে জমিতে সেচ পানি সরবরাহের সুবিধা এবং বৃষ্টির পানি বা বন্যাপানি সহজে নিষ্কাশিত হওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এমন ধরনের সুযোগ থাকলে দেশের কৃষক ভায়েরা ধান উৎপাদনে যত বেশি সম্ভব শ্রম বিনিয়োগ করে আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করবেন। বেশি শ্রম দিয়ে কয়েকবার আবাদ করে এবং অধিক ফলন পেয়ে অনেকের অবস্থার পরিবর্তনও হচ্ছে। জমি তৈরি, চারা রোপণ, সেচ প্রদান, আগাছা দমন, ফসল কাটা ও মাড়াই ইত্যাদি কাজে এক টন বা ২৫ মণ ধান উৎপাদনে গড়পরতা ৪০ জন শ্রমিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। এক টন ধান থেকে ৬৫০ থেকে ৭০০ কেজি চাল হয়। সেই হিসেবে ধান উৎপাদন করে শুকিয়ে মিলে ছাটাই করে প্রতি টন চাল তৈরিতে কমপক্ষে ৬০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। আর প্রতি টন গম উৎপাদনে প্রয়োজন হয় ৪০ শ্রমিকের।
আগে খুব বেশি হলে বছরে দু'বার ধান আবাদ করা যেতো। সময় মতো বৃষ্টি হলে বৈশাখ মাসে বীজ বুনে ও শ্রাবণ মাসে ফসল কেটে আউস ধান এবং বন্যাপানি না এলে বা সরে গেলে ভাদ্র মাসে চারা রোপণ করে ও পৌষ মাসে ফসল কেটে আমন ধানের আবাদ করে। বন্যাপানি না সরলে বৈশাখ মাসে বীজ বুনে পৌষ মাসে ফসল কেটে শুধুমাত্র একবার বোনা আমন ধানের আবাদ করা হতো। আর নিচু এলাকায় আগাম বন্যাপানি আসাতে এবং দেরীতে নিষ্কাশনের ফলে পৌষ মাসে রোপন করে ও বৈশাখ মাসে ফসল কেটে শুধুমাত্র বোরো ধানের আবাদ করা হতো। ধানের দাম কম থাকায় ফসল পরিচর্যায় বেশী শ্রম বিনয়োগ দেয়া লাভজনক ছিলো না। শ্রম বিনিয়োগের প্রয়োজন বা সুযোগ ছিল এখনকার তুলনায় কম। ফলে কৃষক ভাইদের উপার্জনও ছিলো কম।
এদেশে প্রাকৃতিক দূর্যোগে লেগেই থাকে। বন্যা,বৃষ্টির বা সেচ পানির অভাব, ঝড় ইত্যাদি। এ সমস্ত কারণে জমিতে এক মৌসুমে ফসল ধান ভালো না হলে পরবর্তী মৌসুম বেশী শ্রম দিয়ে ও পরিচর্যা করে ভালো ফসল তুলে পূর্বের ঘাটতি পুষিয়ে নেন কৃষক ভায়েরা। যাতে করে পরিবারে বছরের খাদ্যের চাহিদায় যেন ঘটতি না পড়ে। প্রতিটি কৃষক পরিবারে এটাই ছিলো সনাতন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় কৃষক ভায়েরা যদি কোন সহযোগিতা পান তাহলে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে সহজ হয়, অতিরিক্ত উৎপাদন বিক্রি করে বৃদ্ধি করতে পারেন পারিবারিক উপার্জন। যদি চালের বাজার দর লাভজনক ও স্থীতিশীল হয় এবং সেই সাথে যদি থাকে সার ও বীজের সরবরাহ।
কিন্তু এই সহযোগিতা আর কৃষকের কপালে জোটে না। বরং হয় উল্টো। এক মৌসুমে ধান ভালো না হওয়ার কোন ইঙ্গিত পাওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় তড়িঘড়ি করে চাল আমদানি। বিদেশী চালের সরবরাহের ফলে বাজারে কমে আসে দেশে উৎপাদিত চালের চাহিদা। দরও যায় কমে। কৃষক ভায়েরা অতিরিক্ত উৎপাদন সহজে বিক্রি করতে পারেন না, লাভজনক হয়না। ফলে বিনষ্ট হয় তাদের শ্রম।
এবারও তাই। কোন ব্যতিক্রম নেই। মাস তিনেক হলো বোরো ধান ঘরে উঠেছে। হিসেব মতো এই ধান থেকে মাস ছয়েকের চালের যোগান আসবে। সুতরাং বোরো ধানে আরও তিনমাস চলবে। এর মধ্যে আমন ধান উঠবে। অথচ সরকার ৯৬ কোটি টাকা খরচ করে ৩০ হাজার টন চাল এবং ৯২ কোটি টাকা খরচ করে ৫০ হাজার টন গম ক্রয়ের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের অনুমোদন করেছে। বিদেশ থেকে এই চাল ও গম আমদানি হলে কৃষক ভায়েরা অতিরিক্ত উৎপাদনের সুযোগ পাবেন না। গ্রামে কৃষি শ্রমিকরা ধান উৎপাদনে ১৮ লক্ষ এবং গম উৎপাদনে ২০ লক্ষ কর্মদিবস সমান শ্রম নিয়োগের সুযোগ হারাবেন। অর্থাৎ এই চাল ও গম আমদানি না করে দেশে উৎপাদন করলে চলতি ধান উৎপাদন মৌসুমে ৬০,০০০ শ্রমিক ও আগামী গম উৎপাদন মৌসুমে ৬৫,০০০ শ্রমিক এক মাস ধরে শ্রম বিনিয়োগের সুযোগ পেতেন। বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি করা হলে এই সুযোগটা অন্য দেশের শ্রমিকেরা পাবে। দেশে যখন মঙ্গা নিয়ে হৈচৈ হয় এবং কৃষি শ্রমিকের কর্ম সংস্থান নিয়ে সকলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তখন এই চাল আর গম আমদানির অনুমোদন নিঃসন্দেহে দ্বিধার সৃষ্টি করে।
আগেই বলেছি এখন সারা বছর ধরে ধানের আবাদ হয়। কৃষকদের সহযোগিতা করে দেশের মাটিতে সহজেই দেশের শ্রমিক দিয়েই এই খাদ্য উৎপাদন সম্ভব। আমাদের দেশে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি একর বা ৬ কোটি বিঘা (প্রতি বিঘা ৩৩ শতাংশ হিসেবে)। এই জমিতে মৌসুম, জাত, পরিচর্যা, ইত্যাদির ভিত্তিতে প্রতি বিঘায় গড়ে ৮ থেকে ৩০ মণ ধান ও ৯ মণ গম উৎপাদিত হয়। যদি মোট আবাদি জমির শতকরা দুই ভাগ জমিতে বিঘা প্রতি শতকরা ১০ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি করা যায় তাহলে আপাতত ধান আর গম আমদানি না করলেও হয়। সারা দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা রয়েছেন।
তাদের মাধ্যমে দেশের অর্ধেক উপজেলার প্রতিটিতে কমপক্ষে ১০০ কৃষক নির্বাচন করে, প্রতিটি কৃষকের ১ থেকে ১.৫ বিঘা জমিতে চলতি আমন মৌসুমে বিঘা প্রতি ১ মণ অতিরিক্ত ধান এবং পরবর্তী রবি মৌসুমে ১ মণ অতিরিক্ত গম উৎপাদন করতে পারলে আমদানির প্রয়োজন হবেনা। নির্বাচিত কৃষকদের নিকট থেকে এই অতিরিক্ত উৎপাদন বাড়তি কিছূ মুনাফা দিয়ে ক্রয়ের নিশ্চয়তা দিলেই চলবে। আর প্রয়োজনীয় বীজ, সার, সেচ পানি সংগ্রহে সহযোগিতা দিতে পারলে আরো ভালো। বাংলাদেশের কৃষকেরা ধান ও গম উৎপাদনের এই সুযোগ পেলে এবং গ্রামের কৃষি শ্রমিকেরা শ্রম বিনিয়াগের সুযোগ পেলে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
গত চল্লিশ বছরে দেশের প্রতিটি জিনিষের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ডালের দাম প্রতি কেজি ৩ টাকা থেকে ১০০ টাকা, পুটি মাছের দাম ১ টাকা থেকে ২০০ টাকা, বেগুনের দাম ৪ আনা থেকে ৩০ টাকা, কাঁচা মরিচের দাম ১ টাকা থেকে ৬০ টাকা, গরুর মাংসের দাম আড়াই টাকা থেকে ২৫০ টাকা হয়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে ধান বা চালের দাম বাড়েনি। কৃষক ভায়েরা সার বীজ কিনে অতিরিক্ত অর্থ ও নিজের শ্রম বিনিয়োগ দিয়ে ধানের ফলন বৃদ্ধি করে টিকে আছে। এখন যদি বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি অব্যাহত থাকে তাহলে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে কি করে?