অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের ‘মুক্তির’ বিল পাস

দশকের পর দশক অবরুদ্ধ জীবন কাটানো অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের ‘মুক্তির’ পথ প্রশস্ত করে বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ে ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব পাস হয়েছে লোকসভায়।

হুসাইন আহমদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2015, 01:28 PM
Updated : 7 May 2015, 05:50 PM

পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায় পাস হওয়ার একদিন বাদে বৃহস্পতিবার লোকসভায় সীমান্ত বিল নামে পরিচিতি পাওয়া সংবিধান সংশোধনের ১১৯তম প্রস্তাব অনুমোদন পায়।

এই মুহূর্তটিকে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক আখ্যায়িত করেছেন প্রতিবেশী দুই দেশের নেতারা।

দুই দেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী টেলিফোনে কথা বলেছেন পরস্পরের সঙ্গে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও সাধুবাদ জানিয়ে বার্তা এসেছে।

উত্তরাধিকার সূত্রে ভারতের স্থল সীমান্ত নিয়ে এই সমস্যাটি পেয়েছিল বাংলাদেশ। অবিভক্ত ভারতের অংশ থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই সমস্যার অবসানে ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয়।

এর আওতায় ছিটমহল বিনিময়ে বাংলাদেশের দিক থেকে সব প্রক্রিয়া সারা হলেও তা আটকে ছিল ভারতের দিকে। কারণ ভূমি ছাড়তে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন।

এর মধ্যে ২০১১ সালে ভারতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় স্থল সীমান্ত সমস্যার সমাধানে দুই দেশের মধ্যে একটি প্রটোকল সই হয়।

এরপর কংগ্রেস সরকার সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও তার মধ্যেই নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হয়ে যায়। ক্ষমতায় আসে বিজেপি, প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদী।

তবে কংগ্রেস সরকারের সেই উদ্যোগকে সফল করতে আরও সচেষ্ট ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ছিটমহল বিনিময়ে আপত্তি জানানো আঞ্চলিক দলগুলোকে মানান তিনি।

এরপর গত মঙ্গলবার মন্ত্রিসভায় সীমান্ত বিল অনুমোদনের পর তা যায় রাজ্যসভায়। রাজ্যসভায় সর্বসম্মতভাবে বিলটি পাস হয়ে লোকসভায় এলে এখানেও তা পাস হয় একইভাবে।

ভারতের ১১৯তম সংবিধান সংশোধনের বিলটি লোকসভায় উপস্থাপনের সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের দিকটি তুলে ধরেন।

“রাজ্যসভায় এই বিল নিয়ে কেউ আপত্তি জানায়নি। রাজ্যসভা বাংলাদেশকে এই বার্তাই দিতে চেয়েছে যে রাজনৈতিক বিষয়ে ভারতের সব রাজনৈতিক দলের অভিন্ন মত। আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, লোকসভায় যেন সেই শুভবার্তাই দেয়।”

সর্বসম্মতভাবে বিল পাসের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সোনিয়া গান্ধীসহ বিরোধী দলের অপরাপর নেতাদের ধন্যবাদ দিয়েই টেলিফোন করেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী টেলিফোনে নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, “১৯৭৪ সালের ১৮ মে বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, আজ আপনার সরকারের সময় সেই মে মাসেই সেই বিলটি পাস হল।”  

আর শেখ হাসিনা ভারতের সরকার প্রধানসহ জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, “এই স্থল সীমান্ত চুক্তি পাস হওয়ার মাধ্যমে এই উপমহাদেশের তথা বিশ্বের দুই বরেণ্য নেতার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হল।”

নরেন্দ্র মোদীর টুইট

ভারতে যেমন সব রাজনৈতিক দল এই বিলে সম্মতি দিয়েছে, তেমনি বিল পাসের পর ভারতকে সাধুবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশে সরকারবিরোধী দল বিএনপিও। 

সংবিধান সংশোধনের বিলটি পাস হওয়ার পর এখন ভারতের মন্ত্রিসভায় স্থল সীমান্ত চুক্তি ও প্রটোকল অনুমোদন হবে, তারপরই শুরু হবে কার্যকরের প্রক্রিয়া, যার অপেক্ষায় আছে দুই দেশের ছিটমহলগুলোতে থাকা ৫১ হাজার মানুষ।

বিল পাসের পর নরেন্দ্র মোদী টুইটারে লিখেছেন, “এই সংশোধনী পাসের ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমানার স্থায়ী সমাধান হবে এবং বহু দিনের ঝুলে থাকা সীমানা নিয়ে অমীংসাসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হবে।”

গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশের সফরের খবর আলোচনায় থাকলেও কূটনৈতিক সূত্রের খবর, ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান করেই প্রতিবেশী দেশে যেতে চান তিনি।

বাংলাদেশের আমন্ত্রণে বরাবরই নয়া দিল্লি থেকে বলা হচ্ছে, শিগগিরই ঢাকা সফরে যাবেন নরেন্দ্র মোদী।

সীমান্ত চুক্তি কার্যকরের বাধা দূর হওয়ার পর এখন শিগগিরই মুক্তি মিলবে বলে আশায় আছে দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা।

মুক্তির দাবিতে সব সময়ই সরব ছিল ছিটমহলবাসী

বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল রয়েছে, এতে রয়েছে ৩৭ হাজার মানুষের বাস। অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দা ১৪ হাজার। ২০১১ সালে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে শুমারিতে এই তথ্য পাওয়া যায়।

ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের আয়তন মোট ৭ হাজার ১১০ একর; অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ একর।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলে আসছেন, চুক্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (৭১১০ একর জমি) ভারতের অংশ হয়ে যাবে। আর ভারতের ১১১টি ছিটমহল (১৭১৬০ একর জমি) বাংলাদেশের অংশ হয়ে যাবে।

ছিটমহল বিনিময়ের ফলে ভারত যে প্রায় ১০ হাজার একর জমি বেশি হারাবে, সে জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না বলে প্রটোকলে উল্লেখ রয়েছে।

এগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, নীলফামারী জেলায় ৪টি ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে।

প্রটোকলের আওতায় অপদখলীয় ভূমি নিয়ে বিরোধের অবসানও ঘটবে। এতে ভারত অপদখলীয় ২৭৭৭ একর জমির মালিকানা পাবে। আর ২২৬৭ একর জমির উপর বাংলাদেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে।

আর চুক্তি ও প্রটোকল অনুযায়ী ছিটমহলবাসী তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নাগরিকত্ব বেছে নিতে পারবেন। তবে ২০১১ সালের এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ছিটমহলের কিছু বাসিন্দা ভারতে যেতে চাইলেও ভারতের ভেতরে থাকা ছিটমহলের বাসিন্দাদের কেউ বাংলাদেশে আসতে চাননি।

ছিটমহলে বন্দি জীবন

তবে ছিটমহলবাসী সবাই চান চুক্তি কার্যকর, কেননা এক দেশের নাগরিক হয়ে অন্য দেশের মধ্যে থেকে তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মৌলিক সবগুলো অধিকারগুলো থেকেই পুরোপুরি বঞ্চিত। কোনো ভোটাধিকারও নেই তাদের।

তাদের ভাষ্য, ছিটমহল বিনিময় হলে তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত হবে। আর বন্দিজীবন কাটাতে হবে না।

ছিটমহল বিনিময়ে অগ্রগতির প্রতিটি পদক্ষেপে তাই উল্লাস প্রকাশ করছেন ছিটমহলবাসী। এক সময় আপত্তি জানিয়ে আসা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ছিটমহল বিনিময়ে রাজি হলেন, সেদিনও উল্লাসে ফেটে পড়েছিল অবরুদ্ধ এই মানুষগুলো।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় ভারতীয় ১৫০ নম্বর ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার ৬৫ বছর বয়সী কৃষক জহুরুল হক তার আনন্দের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এভাবে- “স্বাধীনতার মুক্তির স্বাদ কী, তা কেবল খাঁচায় বন্দি পাখিই বোঝে; আর হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারি আমরা।”

ভারতের পার্লামেন্টে বিল পাসের পর এখন মুক্তির দিন গুনতে পারবেন তারা।