রনিল বিক্রমাসিংহে: শ্রীলঙ্কাকে টেনে তোলার দায়িত্ব যে ‘বিচক্ষণ শেয়ালের’ হাতে

শ্রীলঙ্কার গত অর্ধশতকের রাজনীতিতে বুদ্ধিমান ও হাল না ছাড়াদের তালিকা করলে সেখানে ‘দ্য ফক্স’ বা ‘শেয়াল’ নামে সুপরিচিত রনিল বিক্রমাসিংহের মতো হাতেগোণা কয়েকজনের নামই পাওয়া যেতে পারে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 July 2022, 11:20 AM
Updated : 20 July 2022, 11:26 AM

বারবার হোঁচট খেলেও কৌশলী ভূমিকার মাধ্যমে প্রতিবারই রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পুনর্জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি; বিরল এ সফলতাই সম্ভবত ৭৩ বছর বয়সী এ রাজনীতিককে এমন ডাকনাম জুটিয়ে দিয়েছে বলে ধারণা গার্ডিয়ানের।

১৯৭৭ সালে রাজনীতিতে প্রবেশের পর ছয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু কী ভাগ্য তার, একবারও মেয়াদ শেষ করতে পারেননি।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার একাধিক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তবে হার মানেননি। অবশেষে বুধবার শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে আইনপ্রণেতাদের গোপন ভোট তাকে তার রাজনৈতিক জীবনের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণের সুযোগ করে দেয়।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে গোটাবায়া রাজাপাকসের স্থলাভিষিক্ত হওয়া ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) এ নেতার হাতেই এখন স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দ্বীপদেশটিকে টেনে তোলার দায়িত্ব।

পেশায় আইনজীবী রনিল ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রীত্ব পেয়েছিলেন, কিন্তু পরের প্রতিবারের মতা সেবারও মেয়াদ শেষ করতে পারেননি তিনি।

এই পদে পরের তিন দশকে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা ইউএনপির এই রাজনীতিক ক্ষমতায়, এমনকী বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালেও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে তার ভালো বোঝাপড়া ও দূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি পশ্চিমাপন্থি সংস্কারক হিসেবে বেশ পরিচিত।

২০০১ সালে দ্বীপদেশটিকে মন্দার হাত থেকে বের করে আনায় তার কৃতিত্ব এখনও বিস্মৃত হয়ে যায়নি। শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে তার জনসমর্থনও ব্যাপক।

নিজেকে ‘পরিচ্ছন্ন’ রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার জেদ থাকলেও দুর্নীতির অভিযোগ তার পিছু ছাড়েনি। যদিও সব অভিযোগেই তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আসছেন।

২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর রনিলের বিরুদ্ধে রাজাপাকসে পরিবারকে দুর্নীতি, মানবাধিকার লংঘনের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার অভিযোগও ওঠে।

রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও রাজাপাকসে পরিবারের সঙ্গে বছরের পর বছর সখ্যতা বজায় রেখেছেন ইউএনপি-র এ নেতা। তার আমলে রাজাপাকসেদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলেও পরে তা থমকে যায়, এবং শেষ পর্যন্ত সেটি ‘নিস্ফলা তদন্তে’ রূপ নেয়।

২০১৯ সালে রনিল যথন প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন, তখন তার বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ ছিল তীব্র। তার দলের কয়েকজন এমপি দল ভেঙে বেরিয়ে নতুন দলও গঠন করেন।

২০২০ সালের নির্বাচনে একসময়ের প্রভাবশালী ইউএনপি এত সামান্য ভোট পায় যে কেবল তিনিই শেষপর্যন্ত পার্লামেন্টে দলের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। 

সেই রনিলই চলতি বছরের মে-তে ফের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফেরেন; শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে ব্যতিব্যস্ত প্রেসিডেন্ট ও দীর্ঘদিনের বন্ধু গোটাবায়া রাজাপাকসের অনুরোধে।

প্রবল জনঅসন্তোষ ও বিক্ষোভের পর গোটাবায়া দেশ ছেড়ে পালিয়ে ইমেইল পদত্যাগপত্র পাঠালে কয়েক মাসের ব্যবধানে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পেয়ে যান তিনি। বুধবার আইনপ্রণেতাদের ভোট তাকে গোটাবায়ার দায়িত্বে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রেখে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে। 

প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া রনিলের জীবনের ৪৫ বছরই পার্লামেন্টে পদচারণা। তিনি প্রথম এমপি হন ১৯৭৭ সালে, মাত্র ২৮ বছর বয়সে।

‘কলম্বো এলিট’ রনিলের বাবা বিশিষ্ট আইনজীবী এসমন্ড বিক্রমাসিংহে শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার মায়ের দিকের আত্মীয় জুনিয়াস রিচার্ড জয়াবর্ধনেকে এখন পর্যন্ত দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ধরা হয়।

জয়াবর্ধেনে ও প্রেমাদাসা সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার রনিল।

১৯৯৪ সালে লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমের (এলটিটিই) সন্দেহভাজন বিদ্রোহীরাদের হাতে গামিনী দিসানায়েকের মৃত্যু হলে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা হন রনিল বিক্রমাসিংহে।

এপ্পাওয়ালা শহরে একটি সভায় বক্তৃতার সময় বোমা বিস্ফোরিত হলে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। দলের দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের থেকে রেহাই পেতে একটি শৃঙ্খলা কমিশন নিয়োগ করে দলের ভাবমূর্তির উন্নয়নও করেন।

নানা ধাঁচে চুল কেটে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার মাধ্যমে রনিল বিক্রমাসিংহে নিজের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে ঘুরে ইউএনপির জনসমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন।

চলতি শতকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য রনিল সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন, কিন্তু তার ভাগ্য তাতে সায় দেয়নি।

২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে ভয়াবহ বোমা হামলায় কমপক্ষে আড়াইশ মানুষের মৃত্যু হয়, সে সময় শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে। বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, হামলার আগে গোয়েন্দা সতর্কতার বিষয়ে তিনি ‘জানতেন না’।

২০২০ সালের নির্বাচনে রাজাপাকসেদের দল এসএলপিপির কাছে শোচনীয় হারের পর গণমাধ্যম রনিল বিক্রমাসিংহের রাজনৈতিক জীবনের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। দলীয় সভাপতির পদ ছাড়ার জন্য ইউএনপির নেতারা দাবিও তুলেছিলেন।

কিন্তু রনিল তাতে কান না দিয়ে পদ আঁকড়েই ছিলেন, শুধু তাই নয়, গত বছর মনোনীত সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টেও ফেরেন। এখন তিনিই প্রেসিডেন্ট; আর তার দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া একাংশ বিরোধী দলের আসনে।

তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে রনিলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বন্ড কেলেঙ্কারিতে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ডুবতে বসা রনিলের পাশে তখন দাঁড়িয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। আর রাজাপাকসেদের বিপদে রনিলও পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন বলে কথাও চালু আছে।

রনিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মাহিন্দার টুইট সেই গুঞ্জনের সত্যতাই তুলে ধরে।

অনেকে বিশ্বাস করেন, ২০১৫ সালে রাজাপাকসে পরিবার যখন ক্ষমতা হারিয়েছিল, সেমময় তাদের সাহায্য করেছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে। আর এবার গোটাবায়া রাজাপাকসে নিজের ক্ষমতা বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টায় তাকে ফিরিয়ে আনেন প্রধানমন্ত্রীর পদে।

শেষপর্যন্ত গোটাবায়া টিকতে পারেননি; দেশ ছেড়ে পালিয়ে আপাতত সিঙ্গাপুরে আছেন। তার পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে বিক্ষোভ দমাতে ‘যা করা দরকার, তাই করার’ নির্দেশ দেন রনিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজাপাকসেরা সরে যাওয়ার পর বিক্ষোভের তীর তার দিকে ঘুরে গেলেও রনিল কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে পরিস্থিতি আপাতত সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

দ্বীপদেশটির অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে ‘বেইলআউটের’ আলোচনাকে দ্রুত সফলতার দিকে নিয়ে যেতে হবে তাকে। মেটাতে হবে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির ঘাটতি; হাতে বিদেশি মুদ্রা না থাকায় গত কয়েকমাস ধরেই এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করতে পারছিল না শ্রীলঙ্কা।

এই ঘাটতি আর ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি শ্রীলঙ্কাকে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলেছে। রনিল কী পারবেন, ডুবন্ত এই দ্বীপদেশটিকে টেনে তুলতে?

আরও পড়ুন-