শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে রাজত্বের কলঙ্কময় ইতি

চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জ্বালানি ও খাদ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ছিল রাজাপাকসে সাম্রাজ্যেরই আধিপত্য।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2022, 06:57 AM
Updated : 13 July 2022, 07:29 AM

সেই রাজাপাকসে পরিবারেরই একজন, প্রেসিডেন্ট গোটাবায়াকে কিনা বুধবার দিনের আলো ফোটার আগেই রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে পালাতে হল।

দুই মাস আগেও তিনি বিক্ষোভকারীদের দাবি উপেক্ষা করে মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তা আর হল না। শনিবার হাজার হাজার বিক্ষোভকারী তার সরকারি বাসভবন দখলে নিলে তিনি আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন, প্রতিশ্রুতি দেন ক্ষমতা ছাড়ার। বুধবারই তার পদত্যাগ করার কথা ছিলো।

“এটা একদিন হওয়ারই কথা ছিলো,” বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এমনটাই বলেন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের চারপাশে ইতস্তত হেঁটে বেড়ানো ৭৩ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মালাওয়ারা আরাচ্চি।

এই বাসভবনে সর্বশেষ ছিলেন গোটাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে, শনিবার থেকে এটি বিক্ষোভকারীদের দখলে।

“তারা জনগণের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। রাজাপাকসে পরিবার বিদায় নেওয়ায় আমরা অদূর ভবিষ্যতেই বিশ্বের সেরা দেশ হবো,” বলেছেন তিনি।

মাহিন্দা গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান, ছেলে যোশিথ ছিলেন তার চিফ অফ স্টাফ; বাবার সঙ্গে তারও বিদায় ঘটে। মাহিন্দার আরেক ছেলে নমল, বড় ভাই চমল, ছোট ভাই বাসিল আর শশেন্দ্রও গত এপ্রিলে মন্ত্রীত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল মঙ্গলবার দেশ ছেড়ে পালাতে চাইলে বিমানবন্দরে বাধার সমুখীন হয়েছিলেন। তাকে দেশের বাইরে যেতে দিলে জনসাধারণের ক্ষোভ আরও প্রকট হতে পারে আশঙ্কায় অভিবাসন কর্মকর্তারা তাকে যাওয়ার অনুমতি দেননি।

তবে শেষ পর্যন্ত বাসিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গোটাবায়ার এই ছোট ভাই মার্কিন নাগরিক। 

প্রায় সোয়া দুই মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কার কাছে এখন জ্বালানি আমদানির জন্য ডলার নেই বললেই চলে। বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতা তাদেরকে ঋণখেলাপি বানিয়ে দিয়েছে। গত মাসেই তাদের মুল্যস্ফীতি ৫৪.৬ শতাংশ ছুঁয়েছে, সামনে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। জ্বালানি বাঁচাতে দেশটিতে স্কুল আর অফিসও বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

১৯৪৮ সালের স্বাধীনতার পর আর কখনোই দেশটি এত বাজে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়েনি, অথচ এর মধ্যে তারা তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধও পার করেছে; ২০০৯ সালে প্রতিরক্ষা সচিব থাকাকালে গোটাবায়াই তামিল বিদ্রোহীদের গুড়িয়ে দেওয়ার কাজ তদারকি করেছিলেন।

অবশ্য শ্রীলঙ্কার এখনকার এ অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সবচেয়ে বেশি দায় কোভিড-১৯ মহামারীর; বৈশ্বিক এ মহামারী দ্বীপদেশটির পর্যটন খাতের গলা টিপে ধরে, বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্সের প্রবাহে নামে ধস।

এর পাশাপাশি রাজাপাকসেদের সরকারের কর কমানোর নীতি আর রাসায়নিক সারে নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। রাসায়নিক সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা অবশ্য কয়েক মাস পরে তুলেও নেওয়া হয়েছিল, তবে যা ক্ষতি হওয়ার তা অতদিনে হয়ে গেছে, খাদ্য উৎপাদনে এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে।

সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে শ্রীলঙ্কার যে আলোচনা চলছে, তা থেকে ফল মিলতে এই বছরের শেষ বা আগামী বছরের প্রথম ভাগ লেগে যেতে পারে। এই পরিস্থিতি কলম্বোকে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের কাছে আরও হাত পাততে বাধ্য করতে পারে।

গোটাবায়া পালিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার স্পিকারের ঘোষণা অনুযায়ী, দেশটির পার্লামেন্ট আগামী ২০ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে।

মাহিন্দার পদত্যাগের পর দায়িত্ব নেওয়া প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেও এরই মধ্যে ‘সর্বদলীয় সরকারের স্বার্থে পদত্যাগের ইচ্ছা’ প্রকাশ করেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুজনই পদত্যাগ করলে সংবিধান অনুযায়ী স্পিকারকেই পার্লামেন্টে নতুন প্রেসিডেন্ট ঠিক হওয়ার আগের কয়েক দিন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে হবে।

“শ্রীলঙ্কা এখন অনিশ্চিত পথে, এ ধরনের অস্থিরতা আমরা কখনোই দেখিনি। প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রী দুজনই যদি পদত্যাগ না করেন, তাহলে আমাদেরকে আরও দীর্ঘসময় অস্থিরতা দেখতে হতে পারে।

“এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি, তা হয়তো সামনে যা হতে পারে তার তুলনায় কিছুই না,” বলেছেন কলম্বোভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ভাবানি ফনসেকা।