মূল্যস্ফীতির উত্তাপ কমাতে বৃষ্টিতেও চোখ ভারতের

খাদ্য ও জ্বালানির দামের ঊর্ধ্বগতিতে ব্যতিব্যস্ত ভারতের নীতিনির্ধারকরা দেশটির পরিবার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সুদের হার বৃদ্ধির চেয়েও চলতি বছর বর্ষার বৃষ্টিপাতের দিকে অধিক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2022, 11:04 AM
Updated : 16 June 2022, 11:04 AM

সমকক্ষ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াও (আরবিআই) দামের উত্তাপ খানিকটা কমাতে আগামী বছরজুড়ে সুদের হার আগ্রাসীভাবে বাড়াবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। কিন্তু দেশটির মূল্যস্ফীতির পেছনে আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকায় কেবল অভ্যন্তরীণ মুদ্রানীতি দিয়ে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে খামতি রয়েই যাবে, মত বিশ্লেষকদের। 

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ভারতের ‍মূল্যস্ফীতির ৭৫ শতাংশ খাদ্যপণ্য থেকে আসছে মনে হওয়ায় বর্ষার বৃষ্টিতে উৎপাদন বৃদ্ধি ও গুদাম যেন ফের ফসলে পরিপূর্ণ হয়ে যায় সেদিকেই নজর থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের। এমনটা হলে তা সরবরাহ সংকট কমাবে এবং আকাশচুম্বী দামে লাগাম টানবে।   

“মুদ্রানীতি সংক্রান্ত পদক্ষেপ কি খাদ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে? সত্যি কথা বলতে কি এর উত্তর হচ্ছে- না,” বলেছেন ইয়েস ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইন্দ্রনীল প্যান।

মুদ্রানীতি কেবল পরবর্তী পর্যায়ের স্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রুখতে ভূমিকা রাখতে পারে, বলেছেন তিনি।

সোমবার প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর মে মাসে ভারতের খুচরা বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। এপ্রিলে এই হার ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল, পরের মাসে খানিকটা কমলেও তা আরবিআইয়ের প্রত্যাশিত সীমার (২-৬ শতাংশ) উপরেই আছে।

ভারতের মূল্যস্ফীতির দুটি প্রধান উৎস হচ্ছে খাদ্য ও জ্বালানি। ইউক্রেইনে রাশিয়ার আক্রমণের কারণে দেখা দেওয়া সরবরাহ ঘাটতি, খারাপ আবহাওয়া ও বিভিন্ন দেশের রপ্তানি বিধিনিষেধের কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারতের বেশিরভাগ খাদ্যপণ্যের দাম বেশ চড়া।

ভারতকে তার উদ্ভিজ্জ তেলের চাহিদার দুই তৃতীয়াংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণসাগর অঞ্চল হতে সূর্যমুখী তেলের আমদানি বন্ধ, আবার ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বিধিনিষেধের কারণে পাম তেলের সরবরাহও ব্যাহত হচ্ছে।

“বিশ্ববাজারে সরবরাহ ফের আগের জায়গায় না যাওয়া পর্যন্ত দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে না,” বলেছেন সলভেন্ট এক্সট্রাক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক বিভি মেহতা।

বর্ষার জাদু

আমদানির এ ঘাটতির জোয়াল অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ওপর চেপে বসেছে; স্বাভাবিক বর্ষা মৌসুম গেলে তা আগামী বছরের মার্চে শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরের দ্বিতীয় ভাগে খাদ্যের দাম কমিয়ে আনবে বলে আশাও করা হচ্ছে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত, ১ জুন থেকে শুরু হওয়া মৌসুমে বৃষ্টি গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম হয়েছে।

“খরায় ফসল নষ্ট হওয়ায় গত কয়েক সপ্তাহে সবজির দাম অনেক বেড়েছে। এখনকার স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টি ফসল রোপণেও দেরি করাচ্ছে,” বলেছেন পুনের এক সবজি ব্যবসায়ী মহেশ সিন্ধে।

ভারতের মোট আবাদী জমির অর্ধেকেরই বেশির বৃষ্টি দরকার হওয়ায় দেশটির মোট ফসল উৎপাদন ও অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে বর্ষাকালের গুরুত্ব অপরিসীম। 

যদি এবার প্রত্যাশা অনুযায়ী বর্ষাকাল না যায়, তাহলে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকারের করার তেমন কিছুই থাকবে না বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। 

দেশটির সরকার গত মাসে গম ও চিনি রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, ভোক্তাদের ওপর পড়া চাপ প্রশমনে বিভিন্ন পণ্যের কর কাঠামোতে একের পর এক পরিবর্তনও এনেছে।

“আরবিআইয়ের ধারণা, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের উপরে থাকবে। যদি টানা তিন প্রান্তিক মূল্যস্ফীতি তাদের বেঁধে দেওয়া সীমার (৬ শতাংশ) উপরেই থাকে, তাহলে আরবিআই এ বিষয়ে সরকারকে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য,” বলেছেন রেটিং সংস্থা সিআরআইএসআইলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ডি কে জোশি।

রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল

দামের ক্ষেত্রে খানিকট স্বস্তি এনে দিতে চমৎকার একটি বর্ষাকাল ভূমিকা রাখতে পারলেও এটা এমন একটি ফ্যাক্টর যার ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

বিশ্বের পঞ্চম শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতি ও দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশটিতে মূল্যস্ফীতির পরিণতির স্মৃতি সুখকর নয়। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম অতীতেও দেশটিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে, যা এড়াতে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে ব্যাপক মনোযোগ দিতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে দাম বাড়লেও মহামারীকালের খাদ্যশস্য বিতরণ প্রকল্পের কল্যাণে ভারতের কর্তৃপক্ষ দেশে গম ও চালের দাম কম রাখতে পেরেছে।

ওই বিতরণ প্রকল্প সেপ্টেম্বরে শেষ হচ্ছে এবং এখন ফসলের মজুদ এক বছর আগের তুলনায় প্রায় ২৯ শতাংশ কম। এসব কারণে গমের দাম বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বৈশ্বিক এক কোম্পানির মুম্বাইয়ের ডিলার। 

তাপপ্রবাহের কারণে ফসল কম হওয়ায় চলতি বছর কৃষকের কাছ থেকে সরকারের গম ক্রয়ও আগের তুলনায় অনেক কমেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে বলেই মনে হচ্ছে।

জিনিসপত্রের দামে ঊর্ধ্বগতি অতীতে ভারতের রাজনীতিক ও আমলাদের বেশ সমস্যায়ও ফেলেছে।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় দেশটির শাসনক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস মূলত মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘরে চলে যাওয়া এবং দুর্নীতির অভিযোগের কারণেই ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। 

“নানান সূচকের পরিমাপে হওয়া মূল্যস্ফীতি গ্রাহকদের কাছে বিমূর্ত ধারণা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যস্ফীতি তার দৈনন্দিন জীবনে, তার পকেটে আঘাত করে।

“ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির তাৎক্ষণিক ও গভীর প্রভাব থাকে। এ কারণেই মোদী সরকারকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে,” বলেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান টিএস লম্বার্ডের রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমিতাভ দুবে।