ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টায় কলকাতার মিন্টো পার্কের কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই কার্টুনিস্ট। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
ভারত সরকারের পদ্মশ্রী খেতাব পাওয়া এই শিল্পীকে পশ্চিমবঙ্গে বিবেচনা করা হয় বাংলা কমিক স্ট্রিপের প্রাণপুরুষ হিসেবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, ভারতে একমাত্র কমিক শিল্পি হিসেবে ডিলিট ডিগ্রি পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া ২০১৩ সালে তাকে ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ ও ‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
আনন্দবাজার জানিয়েছে, ফুসফুস ও কিডনির সমস্যাসহ নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। গত ২৪ ডিসেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু ফুসফুস ও কিডনির সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় তার অবস্থার অবনতি হয়।
রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় ১৬ জানুয়ারি তাকে নেওয়া হয় ভেন্টিলেশনে। সেখান থেকে আর ফেরেননি তিনি। মঙ্গলবার বিকালেই হাওরার শিবপুরে নারায়ণ দেবনাথের শেষকৃত্য হয়।
আনন্দবাজার লিখেছে, “নারায়ণ দেবনাথ বাংলা কমিক্স সাহিত্যের প্রথম পর্বের অন্যতম দিশারী। বাঁটুল দি গ্রেটের স্ট্রিপে চোখ রাখলে বোঝা যায়, এর কুশীলবরা এক অলীক নগরীর বাসিন্দা। সেই ভুবনে কেমন যেন একটা কাউবয় অধ্যুষিত আমেরিকান ওয়েস্টের গন্ধ। তবে সেখানে হিউমার সৃষ্টি হয় একেবারেই বাঙালি কেতায়।
“তবে ‘হাঁদা-ভোঁদা’র পরিমণ্ডল কিন্তু ষোল আনা বাঙালি। রোগা-পাতলা হাঁদা তার চালাকি নিয়ে নাজেহাল হবেই আর সহজ-সরল মোটাসোটা ভোঁদা জিতবে শেষমেশ— এই কাঠামো বার বার পুনরাবৃত্ত হলেও একটুও একঘেয়ে লাগেনি। কারণ একটাই— এই কমিক স্ট্রিপ খুদে দস্যিদের একাত্ম বোধ করাতে পেরেছিল।
“তবে তুলনায় ‘নন্টে-ফন্টে’র দুনিয়া একেবারেই আলাদা। ছাত্রাবাসের ঘেরাটোপে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পাতিরাম হাতি (নাকি হাতিরাম পাতি?) আর বেয়াদপ সিনিয়র কেল্টুর সঙ্গে নন্টে-ফন্টের অনিঃশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হোস্টেল জীবন কাটিয়ে আসা বঙ্গসন্তানকে এখনও স্মৃতিভারাক্রান্ত করে।”
এর বাইরেও ‘বাহাদুর বেড়াল’, ‘ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু’, ‘ডিটেকটিভ কৌশিক রায়’, ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়’ এর মত বেশ কিছু কমিক সিরিজ রচনা করেছেন নারায়ণ দেবনাথ।
শিল্পীর ছেলে তাপস দেবনাথকে উদ্ধৃত করে হিন্দুস্থান টাইমস লিখেছে, শিবপুরের ছোট, ছোট দুষ্টু ছেলেদের সঙ্গে দারুণ ভাব ছিল তার বাবার। তাদের নানা মজার কাণ্ডই সামান্য রঙ চড়িয়ে ও তাতে গল্প মিশিয়ে দু’পাতার মধ্যে নিয়ে আসতেন তিনি।
নারায়ণ দেবনাথ কেবল কমিক স্ট্রিপেই আঁকেননি, সত্তর আর আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা বইয়ের অলঙ্করণেও অন্যতম প্রধান শিল্পী ছিলেন তিনি।
মমতা লিখেছেন, “বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যশিল্পী ও কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল প্রভৃতি চরিত্রের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ সব বয়সের পাঠকের মনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন। তার পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।”
গুণী এই শিল্পীর জন্ম হাওরার শিবপুরে, সেখানেই তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। তার পূর্বপুরুষের ভিটা একসময় ছিল বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে (বিক্রমপুর)। ১৯২৫ সালে নারায়ণ দেবনাথের জন্মের আগেই তারা হাওরার শিবপুরে চলে যান।
অল্প বয়স থেকেই আঁকিবুকিতে ঝোঁক ছিল নারায়ণের। বাড়িতে তৈরি করা গয়নার নকশা করতেন তখন থেকেই। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন আর্ট কলেজে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে আর্ট কলেজ পর্বের ইতি ঘটে। তারপর বিজ্ঞাপনী সংস্থার হয়ে কাজ শুরু করেন।
দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদকমণ্ডলীর উৎসাহে পরে কমিক স্ট্রিপ আঁকতে আর লিখতে শুরু করেন নারায়ণ দেবনাথ। তার প্রথম সৃষ্টি হাঁদা-ভোঁদা ২০১২ সালে ৫০ বছর পার করে।
হিন্দুস্থান টাইমস লিখেছে, স্বল্পভাষী ও প্রচারবিমুখ এই শিল্পী বছর চারেক আগেও সমান দক্ষতায় কমিক স্ট্রিপ এঁকে গেছেন। এ নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, “ছোটদের খুব ভালোবাসি, তাই। তাদের জন্য তুলিকলম ছাড়তে পারিনি।”