বিবিসির সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাসের মতে, মোদীর এ সিদ্ধান্ত যেমন কৌশলী এক রাজনৈতিক চাল, তেমনি দেরিতে হলেও তাড়াহুড়া, একগুঁয়েমি ও আইন প্রণয়নে দূরদর্শিতার ঘাটতির প্রমাণ।
এতদিন অনড় অবস্থানে থেকেও এখন মোদীর পিছু হটার কারণগুলো ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন এক প্রতিবেদনে।
বাজার উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রণীত তিন কৃষি আইন পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশে অভূতপূর্ব বিক্ষোভের আগুন উসকে দিয়ে মোদীর সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ খাঁড়া করেছিল। শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবে কৃষক ও সুশীল সমাজ রাজপথে নামলে তা উত্তর প্রদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সামনের বছরই এখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় নির্বাচন হবে।
এর আগে মোদী সরকার বিক্ষোভকারীদের গালমন্দ করেছে এবং অনড় মনোভাব দেখালেও নজিরবিহীন ‘ধরা খাওয়া’ বিজেপি শেষ পর্যন্ত শিখদের শান্ত করার চেষ্টা করেছে। এ মাসের শুরুর দিকে দলের কার্যনির্বাহীদের যেসব সভা হয়েছে, তার সবগুলোতেই এই জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করার চেষ্টা ছিল: কৃষি বাজেট ও ফসলের দাম বাড়ানো, পাকিস্তানে শিখদের পবিত্র স্থান পরিদর্শনে ঐতিহাসিক করিডোর আবার খুলে দেওয়া এবং ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে শিখবিরোধী দাঙ্গায় দোষীদের সাজা দিতে নতুন করে তদন্ত করা।
শুধু তাই নয়, আইনগুলো নিয়ে শিখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাড়তে থাকা বিচ্ছিন্নতা নিয়েও যে সরকার নার্ভাস হয়ে পড়েছিল, তা খুবই স্পষ্ট। সীমান্তবর্তী রাজ্য পাঞ্জাবে ইতিহাসের শিক্ষা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই জনগোষ্ঠীর একই ধরনের বিচ্ছিন্নতা থেকে ১৯৮০র দশকে সহিংস বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল।
কৃষি সংস্কার আইনগুলো বাতিলের মাধ্যমে সাধারণভাবে কৃষকদের মধ্যে ও বিশেষভাবে শিখদের মধ্যে আস্থা ফিরে পাওয়ার আশা করছেন মোদী। তবে আসন্ন রাজ্যসভার ভোটে এটা তার দলের সুযোগ বাড়াবে কিনা তা বিচার্য বিষয়।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও মহামারীজনিত অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ভঙ্গুর অর্থনীতির বের হওয়ার চেষ্টার মধ্যে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো না।
কৃষকরা বিক্ষুব্ধ, তার মধ্যে উত্তর প্রদেশে বিজেপির নেতাই কৃষকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার দায়ে অভিযুক্ত। পাঞ্জাবে স্থানীয় নির্বাচনের প্রচারণার সময় প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন দলটির নেতারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের ফেলো রাহুল ভার্মাকে উদ্ধৃত করে সৌতিক লিখেছেন, “যখন কোনো কিছুই অনুকূলে নেই, তখন উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে আপনার বিরোধীরা যাতে সুবিধা না নিতে পারে, আপনি সেই পদক্ষেপই নেবেন। কৃষি আইনগুলো প্রত্যাহার সেরকম লক্ষ্যেই করা হচ্ছে।”
এই চাল নির্বাচনে বিজেপিকে তেমন কোনো সুবিধা দেবে- তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। যত যাই হোক, পাঞ্জাবে বিজেপি সুবিধা খুব সামান্যই পাবে। ৪৮০ বিধায়কের পশ্চিমাঞ্চলীয় উত্তর প্রদেশে, যেখানে বিজেপি ৬০ থেকে ৮০ আসন জিতে, সেখানে দল কিছুটা সুফল ঘরে তুলতে পারে।
উত্তর প্রদেশের আসনগুলোতে সম্ভাব্য ধস এভাবে ঠেকিয়ে নেতৃত্বস্থানীয় রাজ্যে ‘সহজে’ জেতার এবং দৃঢ় পদক্ষেপে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আশা করছে বিজেপি।
তার সরকার ভূমি অধিগ্রহণ আইন ও নতুন শ্রম আইনের বিধানগুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে এবং বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনও বিলম্বিত হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায়ের বড় অংশের পেছনে আছে সংসদে বিরোধীদের সঙ্গে দলের সম্পৃক্ত হতে না পারা এবং আইন প্রণয়নে তাড়াহুড়া।
‘বলিষ্ঠ ও অনড়’ হিসেবে পরিচিত নেতা মোদী তার সমর্থকদের স্বল্প মেয়াদে হতাশই করবেন; আর বিরোধীরা চাঙা হবে। মোদীর নেতৃত্ব ঘিরে যে একটা ‘অজেয়’ ভাব তৈরি হয়েছিল, তাতে মারাত্মক এক ঘা লেগেছে।
এদিকে দুর্বল হয়ে পড়া বিরোধী দলের নগন্য প্রতিরোধের মুখে থাকা সংগরিষ্ঠ একটা সরকারকে একটা গণআন্দোলন যে হয়রান করে ফেলতে পারে এঘটনায় তা খুবই স্পষ্ট।
তবে নিজের অনুকূলে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মোদী খুবই চতুর। তাই সামনের দিনগুলোতে তিনি কী রাজনৈতিক চাল দেবেন, তা সচেতন মহল আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে।
তবে যারা কৃষি সংস্কারের এসব প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন, তাদের জন্য মোদীর এই পিছু হটা এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে হাজির হয়েছে।
সৌতিক বিশ্বাসের মতে তা হলো- ‘ভালো অর্থনীতি প্রায়ই বাজে রাজনীতি হিসেবে হাজির হয়’। বিশেষ করে, প্রধান অংশীজন ও সরকারের মধ্যে যখন আস্থার ঘাটতি থাকে এবং রাজনীতি যখন দলীয় ও সংলাপহীন হয়।
আরও পড়ুন: