ভারতে অভিনেতা পুত্র ও মন্ত্রীপুত্রের সঙ্গে ‘বিপরীতধর্মী আচরণ’

ভারতে এখন শীর্ষ এক বলিউড অভিনেতা ও ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের এক প্রতিমন্ত্রী- এ দুইজনের দুই ছেলেকে নিয়ে চলছে ভিন্নমুখি প্রচারণা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2021, 10:42 AM
Updated : 5 Oct 2021, 10:42 AM

একজনকে মিডিয়া ট্রায়ালে তুলোধুনো করা হচ্ছে, অন্যজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ অপেক্ষাকৃত গুরুতর হলেও তার দিকে তেমন নজরই দেওয়া হচ্ছে না।

প্রথমজন আরিয়ান খান। বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের ২৩ বছর বয়সী ছেলে। এক অনুষ্ঠানে মাদক নেওয়ার অভিযোগে রোববার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দ্বিতীয়জন আশিষ মিশ্র। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সহকর্মী প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে। আশিষের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আন্দোলনরত একদল কৃষকের ওপর গাড়ি চালিয়ে দিতে তার গাড়িচালককে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে একাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

আরিয়ান ও আশিষ দুজনই তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। দুটি ঘটনার মধ্যে কোনো ধরনের সংযোগও নেই। 

কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই দুই তরুণের সঙ্গে যে বিপরীতধর্মী আচরণ করেছে এবং আরিয়ানের ঘটনায় ভারতীয় গণমাধ্যম যে মাত্রার মনোযোগ দিয়েছে তাতে অনেকে কিছু কিছু সংবাদ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন; সুনির্দিষ্ট কিছু টিভি স্টেশনের বিরুদ্ধে ‘বলিউডকে কলঙ্কিত’ করার চেষ্টারও অভিযোগ উঠেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

আরিয়ানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মুম্বাই থেকে গোয়াগামী একটি প্রমোদতরী থেকে। শাহরুখ খানের পরিবার মুম্বাইতে বাস করে। আর আরিয়ান যেখানে যাচ্ছিলেন, সেটি পর্যটকদের জন্য স্বর্গ হিসেবে খ্যাত।

ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো (এনসিবি) ‘অবৈধ মাদক রাখা, গ্রহণ ও বিক্রি সংক্রান্ত’ আইনে ওই প্রমোদতরী থেকে আরিয়ানসহ আরও কয়েকজনকে আটক করে। ২৩ বছর বয়সী আরিয়ানকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রিমান্ডে থাকতে হচ্ছে।

তাকে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত নথিপত্রের ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষকরা বলছেন, যে পরিমাণ মাদক পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা এতই কম যে এ জন্য তাকে (আরিয়ান) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে রাখার কোনো কারণই ছিল না।

আরিয়ানের আইনজীবী সতীশ মনসিন্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে তার মক্কেলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রোববারের শুনানিতে বিচারককে তিনি বলেছেন, আরিয়ান ওই প্রমোদতরীতে ওঠার আগে তাকে দুইবার তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয়েছিল, কোনোবারই তার কাছে নিষিদ্ধ কিছু পাওয়া যায়নি।

“সেখানে তিনি মাদক নিয়েছেন, এমন কোনো প্রমাণও নেই,” বলেছিলেন মনসিন্ধে।

দ্বিতীয় ঘটনাটির কেন্দ্রে আশিষ মিশ্র। রোববার অজয় মিশ্রের গাড়িবহরের একটি গাড়ি উত্তর প্রদেশের লখিমপুর খেরির আন্দোলনরত কৃষকদের একটি দলের উপর তুলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর আশিষের নাম সামনে চলে আসে।

এ ঘটনায় ৮ জন নিহত হয়েছে; তার মধ্যে গাড়ি চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে ২ এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে ২ বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে কৃষক ইউনিয়নগুলো। উন্মত্ত বিক্ষোভকারীদের হাতে মারা পড়ে তিন বিজেপি কর্মী ও গাড়িটির চালক।

প্রাথমিকভাবে পাওয়া কিছু প্রতিবেদনে আশিষ মিশ্রকে উদ্বৃত করে বলা হয়, বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে বাঁচতে তিনি ক্ষেতখামার দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলেন।

পরে আশিষ দাবি করেন, ঘটনার সময় তিনি ওই গাড়িতে ছিলেনই না। তার বাবাও একই কথা বলেছেন।

বিরোধী দল ও কৃষক ইউনিয়নগুলোর তীব্র প্রতিবাদের মুখে সোমবার পুলিশ ওই ঘটনার তদন্ত শুরু করে এবং অজয় ও তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে।

“অভিযোগ দায়েরে পুলিশের অনীহা ও দেরি ক্ষমার অযোগ্য। লখিমপুরের ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে, অথচ সব আলোচনা হচ্ছে আরিয়ানের গ্রেপ্তার নিয়ে,” বলেছেন উত্তর প্রদেশের সাবেক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা ভিক্রম সিং।

রোববার সারা দিনজুড়ে ভারতের বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল ব্যস্ত ছিল আরিয়ানকে নিয়ে। তাকে গ্রেপ্তারের ছবি ও ভিডিও দফায় দফায় দেখানো হয়েছে, তার ‘গ্রেপ্তার সংক্রান্ত মেমো’ টিভি পর্দায় বারবার এসেছে, হোয়াটসঅ্যাপে ব্যাপক শেয়ার হয়েছে।

টিভি অনুষ্ঠানের সঞ্চালকরা আরিয়ানের গ্রেপ্তারকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ‘বলিউড ও মাদকের মধ্যে সম্পর্কের অবসান ঘটাতে হবে’ জাতীয় মন্তব্যও করেছেন। অতিথি আলোচকরা শাহরুখপুত্রকে নিয়ে প্রমাণিত নয় এমনসব দাবি করেছেন, ‘সন্তানের প্রতি খেয়াল না রাখায়’ বলিউড সুপারস্টার ও তার স্ত্রীর ব্যাপক সমালোচনাও করেছেন। টুইটারে আরিয়ান খানের নাম ট্রেন্ড হয়েছে ‘বলিউড ড্রাগিস’ ও ‘বলিউড ড্রাগিস শেমিং নেশন’ হ্যাশট্যাগের সঙ্গে।

আর লখিমপুর খেরির ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও পুলিশ আশিষ বা তার বাবা কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেনি, টিভি চ্যানেলগুলোও চুপচাপ।

টিভির নামকরা সঞ্চালকদের মুখে নেই প্রতিমন্ত্রী ও তার ছেলেকে গ্রেপ্তারের দাবি। কেউ কেউ উল্টো কৃষকদেরই সহিংসতার জন্য দায়ী করেছেন। আশিষ বা লখিমপুরের ঘটনা টুইটারেও ট্রেন্ড হয়নি।

একসময় সাংবাদিকতা করা জন থমাস বলছেন, ভোক্তাদের চাহিদা ও তারকাপুত্র হওয়ার কারণেই আরিয়ানের প্রতি বেশি মনোযোগী ছিল গণমাধ্যম।

“অন্যদিকে রাজনীতিকের ছেলে দেশজুড়ে খুব একটা পরিচিত নয়। মোদী সরকারের প্রতিমন্ত্রীকেই বা কে চেনে?,” বলেছেন তিনি।

কিন্তু সব কভারেজ আরিয়ানের ওপর রাখার পেছনে বলিউডকে কলঙ্কিত করার ‘একটি গোপন উদ্দেশ্য, একটি কুটিল রোডম্যাপ’ আছে বলেও মনে করেন থমাস।

তিনি বলিউড অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তীর ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে বলেন, গত বছর রিয়ার সঙ্গী অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃতদেহ তার মুম্বাইয়ের অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়ার পর ভারতের কয়েকজন নামকরা সাংবাদিকের নেতৃত্বে রিয়ার বিরুদ্ধে মারাত্মক অপপ্রচার চলে।

“রিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো ভিত্তিই ছিল না, কিন্তু (অপপ্রচারে) তার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায়। আরিয়ানকে গ্রেপ্তারের যে মেমো দেখানো হচ্ছে, তাতে মাদকের পরিমাণ নগণ্য, অথচ তার পরিবারের মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে,” বলেন থমাস।

আরিয়ানকে জামিন না দেওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এটা জামিনযোগ্য অপরাধ। তাহলে এনসিবি কেন তাকে রিমান্ডে চাইল?”

“তাদের (এনসিবি) উচিত হয়নি অভিযুক্তের পরিচয় প্রকাশ করা, গণমাধ্যমেরও উচিত নয় গ্রেপ্তারের পর তার যাবতীয় পদক্ষেপ অনুসরণ করা ও প্রতিবেদন করা,” বলেছেন তিনি।