কোভিড-১৯: ভারত ও মোদী সরকারের জন্য কেরালার শিক্ষা

অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায় বেশি কোভিড রোগী শনাক্ত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল কেরালাকে যতই নিন্দামন্দ করুক না কেন, দক্ষিণের এ রাজ্যের দৃশ্যত ‘বাজে রেকর্ড’ থেকেই প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিতে পারে সংক্রমণের সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউয়ের অপেক্ষায় থাকা ভারত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 August 2021, 12:56 PM
Updated : 26 August 2021, 01:09 PM

কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত, ঘনবসতিপূর্ণ কেরালাতে এখন ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের দেখা মিলছে; মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যায়ও রাজ্যটির অবস্থান সবার উপরে থাকা মহারাষ্ট্রের পরেই। এজন্য মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতারা প্রায়ই কেরালার রাজ্য সরকারকে তুলোধুনোও করছেন।

তবে জাতীয় ও রাজ্য পর্যায়ের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের পর্যালোচনা, মহামারী বিশেষজ্ঞ ও কেরালার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সাক্ষাৎকারে পাওয়া যাচ্ছে ভিন্ন ছবি।

দক্ষিণের রাজ্যটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় আগেভাগে রোগী শনাক্ত হচ্ছে। যার কারণে কর্তৃপক্ষ সহজেই রোগের চিকিৎসায় ব্যবস্থা নিতে পারছে, নাটকীয়ভাবে কমাতে পারছে মৃত্যুহার।

কেরালার এই ছবির একেবারে বিপরীত চিত্র দেখা গিয়েছিল কয়েক মাস আগে দিল্লির মতো ভারতের বেশ কয়েকটি বড় শহরে; অক্সিজেন ও শয্যার ঘাটতির কারণে চিকিৎসা না পেয়ে সেসময় হাসপাতালের বাইরে, কার পার্কিংয়ে অসংখ্য লোককে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

“যদিও র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের একরকম মত আছে, তবুও রাজ্যটির (কেরালা) কৌশল এবং বড় ধরনের সফলতাকেও বিবেচনায় নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কেবল মৃত্যুহার কম রাখতে পারাটাই নয়, তারা প্রতি ৬ রোগীর একজনকে শনাক্ত করতে পারছে, যেখানে জাতীয়ভাবে এটি হচ্ছে প্রতি ৩৩ জনে এক,” বলেছেন নয়া দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব সোশাল মেডিসিন অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথের প্রধান রাজীব দাসগুপ্ত।

কেরালায় জনসংখ্যার ঘনত্ব জাতীয় গড়ের দ্বিগুণের বেশি।

জনসংখ্যার ঘনত্ব ও কার্যকর শনাক্তকরণ পদ্ধতি- এই দুইটি বিষয় বিবেচনায় নিলেই বোঝা যায়, কেন কেরালায় বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে।

অথচ এরপরও কেরালায় কোভিডে মৃত্যু হার ০.৫%, যা ভারতের তুলনামূলক কম জনসংখ্যার একটি রাজ্য বাদে অন্য সব রাজ্যের চেয়ে কম।

ভারতে জাতীয় পর্যায়ে শনাক্ত অনুপাতে মৃত্যু ১ দশমিক ৪ শতাংশ, দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশে এটি ১ দশমিক ৩ শতাংশ।

অন্যদের সঙ্গে কেরালার এই পার্থক্যের পেছনে রয়েছে রোগী শনাক্তে র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ওপর নির্ভরশীলতা এবং আক্রান্তদের বাড়িতেই কঠোর আইসোলেশনে রাখা।

এসব পদক্ষেপ নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যাপক সমালোচনা করলেও কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত রাজ্যটির কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের নেওয়া পদক্ষেপের কারণেই কাদের কাদের হাসপাতালে নেওয়া বা অক্সিজেন দেওয়া দরকার তা নির্ধারণ করা সহজ হচ্ছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রোগী শনাক্তে তুলনামূলক নির্ভুল ফল দেওয়া আরটি-পিসিআর টেস্ট করাতে নির্দেশনা দিয়েছে; এ পদ্ধতিতে ফল পেতে খানিকটা দেরি হয়। এই সময়ের মধ্যেই কারও কারও রোগের লক্ষণ প্রকট আকার ধারণ করতে পারে, শনাক্তকরণ পরীক্ষার ফল পাওয়ার আগে তিনি ভাইরাস অন্যদের মধ্যে ছড়িয়েও দিতে পারেন, যা সংক্রমণ ও মৃত্যুর দুষ্টচক্রকে অব্যাহত রাখতে পারে।

কেরালায় র‌্যাপিড টেস্টের ফলাফল অনুযায়ী দ্রুত রোগী শনাক্ত করে তাদেরকে বাড়িতে আইসোলেশনে রেখেই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে, ভাইরাস অন্যদের মধ্যে ছড়ানোর সম্ভাবনাও কমছে, বলছেন রাজ্যটির কর্মকর্তারা।

ভারতের বেশিরভাগ এলাকার তুলনায় কেরালায় চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতিও তুলনামূলক কম। এসবই দেখাচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত রাজ্যটিতে মৃত্যুহার কেন কম।

কেরালার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফোনে পরামর্শ, বাড়িতে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের ওষুধ এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা শনাক্তে ব্যবহৃত পালস অক্সিমিটার দেওয়াসহ রাজ্য পরিচালিত কোভিড সহায়তা সেবাও রোগটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।

দিল্লিতে একই ধরনের সহায়তা কাঠামো থাকলেও রোগীর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তা ধসে পড়েছিল।

“আমাদের মডেল আলাদা হলেও মৃত্যুহার দেখাচ্ছে আমাদের মডেলটা ঠিক পথেই আছে,” বলেছেন কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিনা জর্জ।

অবশ্য এতেই আত্মতৃপ্তিতে ভেসে যাচ্ছেন না তারা, সতর্ক না থাকলে দ্রুত-পরিবর্তনশীল মহামারী যে সবচেয়ে সেরা পরিকল্পনাও চুরমার করে দিতে পারে সেই হিসাব তাদের আছে।

রয়টার্সের প্রতিনিধিরা সম্প্রতি কেরালার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ মালাপ্পুরাম জেলায় গিয়েছিলেন।

ভারতের যে জেলাগুলোতে সবচেয়ে বেশি কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে, মালাপ্পুরাম তার একটি। অথচ সেখানে এখন সবচেয়ে বড় হাসপাতালের ৩৪৪টি কোভিড শয্যার এক চতুর্থাংশই খালি পড়ে আছে, অক্সিজেন সরবরাহও যথেষ্ট।

যেসব জেলায় শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ১০ শতাংশের বেশি ‘পজেটিভ’ ফল পাওয়া যাবে, সেসব জেলায় লকডাউন দেওয়ার সুপারিশ করেছিল ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ। কেরালায় শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ‘পজেটিভ’ পাওয়ার হার গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ, মালাপ্পুরামে এই হার আরও বেশি। অথচ সেখানে দোকানপাট ও রেস্তোরাঁ ঠিকই খোলা দেখা গেছে।

কেরালার কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে তারাই সবচেয়ে বেশি শনাক্তকরণ পরীক্ষা করছেন, যে কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সাহস দেখানো যাচ্ছে।

বেশি শনাক্তকরণ পরীক্ষার এই মডেল চিকিৎসা কাঠামো ভালো ভারতের এমন আরও কয়েকটি রাজ্যেও প্রচলণ করা যেতে পারে বলে মত মহামারী বিশেষজ্ঞদের।

“তাদের নজরদারি ভালো, তারা আগেভাগে রোগী শনাক্ত করতে পারছে; শনাক্তকরণ পরীক্ষার ওপর তারা বেশি মনোযোগ দিয়েছে। কেরালার বেশিরভাগ মানুষই শিক্ষিত, এটাও সাহায্য করেছে,” বলেছেন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম পরামর্শদাতা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজির অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক এম ডি গুপ্তে।

কেরালা প্রসঙ্গে মন্তব্য চেয়ে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রয়টার্স ইমেইল করলেও তার জবাব পাওয়া যায়নি।

মহামারীর আগে ভারতে মেডিকেল অক্সিজেনের দৈনিক যে চাহিদা ছিল, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যগগনে মে’তে তা ৮ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে কেরালায় কখনোই হাসপাতাল শয্যা বা অক্সিজেনের বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যায়নি।

রাজ্যটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী জর্জ বলছেন, তারা এখন দ্রুতগতিতে টিকাদানের মাধ্যমে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই রাজ্যের সব প্রাপ্তবয়স্ককে কোভিড টিকার অন্তত একটি ডোজ দিতে চান।

কেরালায় ৫৫ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক এরই মধ্যে টিকার একটি ডোজ পেয়েছেন।

সারা ভারতে এক ডোজ টিকা পাওয়া প্রাপ্তবয়স্কের সংখ্যা ৪৮ শতাংশ। দেশটি ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রাপ্তবয়স্ককে ভ্যাকসিন দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।

কেরালার জনসংখ্যা তিন কোটি ৫৫ লাখ, রাজ্যটিতে এখন পর্যন্ত ৩৮ লাখ কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে; এই সংখ্যা ভারতের মোট শনাক্ত রোগীর ১২ শতাংশ।

বিপুল সংখ্যক রোগী শনাক্ত হলেও কেরালায় কোভিডে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৯ হাজার ৭৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে; যা ভারতের মোট মৃত্যুর ৪ শতাংশের কাছাকাছি।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড-১৯ শনাক্তে যত পরীক্ষা হবে তার ৭০ শতাংশ আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করতে বললেও কেরালায় এই পদ্ধতিতে পরীক্ষার হার ৫০ শতাংশেরও কম বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

“এটা কেরালা মডেল নয়, এটা অব্যবস্থাপনার মডেল,” গত সপ্তাহে কেরালার পরিস্থিতি নিয়ে এমনটাই বলেছিলেন বিজেপির সভাপতি জগৎ প্রকাশ নড্ডা।

বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ কেরালার চেয়েও ভালোভাবে মহামারী সামলেছে বলে মত তার।

যদিও জুলাইয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এক জরিপে উত্তর ও মধ্য প্রদেশের ৭০ শতাংশের বেশি বাসিন্দা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল; কেরালায় আক্রান্তের এ সংখ্যা অনুমান করা হয়েছিল ৪৪ শতাংশ।

রাজ্যটিতে এখন কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি করা লাগছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। মে’তে সংক্রমণ পরিস্থিতি চূড়ায় থাকার সময় ভারতজুড়ে হাসপাতালে ভর্তির এ হার ছিল ৫ শতাংশের উপরে।

কেরালার কোভিড বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য টি এস অনিশ জানান, তাদের মনোযোগ এখন টিকায়।

“আপনি যদি বিপুল সংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে পারেন, তাহলে মানুষ আক্রান্ত হলেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ততটা চাপ পড়বে না,” বলেছেন তিনি।