কোভিড-১৯: হামলা বন্ধে ব্যবস্থা চান ভারতের চিকিৎসকরা

ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্য আসামের হোজাই জেলার একটি কোভিড সেবাকেন্দ্রে চিকিৎসক হিসেবে চাকরি শুরু হয়েছিল ড. সেনাপতির। কাজে যোগ দেওয়ার দ্বিতীয় দিন তাকে সকালে ভর্তি হওয়া এক রোগীর অবস্থা দেখতে বলা হয়; কিন্তু তিনি যতক্ষণে ওই রোগীর কাছে যান, ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2021, 10:39 AM
Updated : 6 July 2021, 01:19 PM

রোগীর মৃত্যুর খবর শুনে পরিবারের সদস্যরা যেন ক্ষেপে উঠল; তাৎক্ষণিকভাবে তারা সারা কক্ষজুড়ে চেয়ার ছুড়ে মেরে জানালার কাঁচ ভাঙচুর আর সেবাকেন্দ্রের কর্মীদের ওপর হামলে পড়েছিল বলে মনে পড়ে এই চিকিৎসকের।

নিজেকে বাঁচাতে দৌড়ে পালিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেয় এবং তাকে খুঁজে বের করে।

হতবাক করে দেওয়া হামলার এক ভিডিওতে উন্মত্ত একদলকে, যাদের অধিকাংশই পুরুষ, সেনাপতির গায়ে লাথি মারতে এবং বেডপ্যান দিয়ে তার মাথায় আঘাত করতে দেখা যায় বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

উন্মত্ত ওই লোকজন সেনাপতিকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে এবং তাকে মারতেই থাকে।

ভিডিওতে জামাকাপড় ছেঁড়া, রক্তাক্ত ড. সেনাপতিকে ব্যথায় ও আতঙ্কে হাউমাউ করে কাঁদতেও দেখা গেছে।

“মনে হয়েছিল, আমি বাঁচবো না,” বলেন তিনি।

ভারতে গত বছর মহামারী শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত সেনাপতির মতো বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে কোভিড রোগীদের পরিবারের সদস্যদের হামলার শিকার হতে হয়েছে।

যারা হামলা করেছে, তাদের সবার একটাই অভিযোগ – তাদের প্রিয়জনের যথাযথ চিকিৎসা হয়নি, কিংবা সময়মতো হাসপাতালের শয্যা বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

এসব হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশটির চিকিৎসকরাও একের পর এক প্রতিবাদ আর ধর্মঘট করেছেন। দাবি জানিয়েছেন, হামলা বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়নের। মহামারীর এই দুঃসহ সময়ে তাদের ওপর চাপ কমাতে আরও কর্মী নিয়োগ এবং অবকাঠামোর উন্নয়নও চেয়েছেন তারা।

চিকিৎসকদের ওপর হামলা মোকাবেলায় ভারতের হাসপাতালগুলোরও তেমন কোনো প্রস্তুতি দেখা যায় না। ড. সেনাপতির ওপর যখন হামলা হয়, তখন কেউ তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। সেবাকেন্দ্রের বাকি কর্মীরা হয় লুকিয়ে ছিল কিংবা ততক্ষণে মারধরের শিকার হয়েছে। উন্মত্ত ওই লোকজনের সামনে হাসপাতালের একমাত্র নিরাপত্তা রক্ষীও অসহায় ছিল।

“আমার জামাকাপড় ছিঁড়ে গিয়েছিল, স্বর্ণের চেইন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং মোবাইল ফোন ও চশমা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মিনিট বিশেক পর আমি কোনোমতে পালিয়ে বাঁচি,” বলেন ড. সেনাপতি।

এরপর এই চিকিৎসক সোজা থানায় যান, করেন মামলা। তার ওপর হামলার ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে হৈ চৈ পড়ে যায়। রাজ্য সরকার এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়; অপ্রাপ্তবয়স্ক তিনজনসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়।

ভারতে কোভিড-১৯ এর এ সময়ে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর হামলার বিষয়টি অনেক বেশি ‍গুরুত্ব পেলেও, দেশটিতে মহামারীর আগেও এ ধরনের হামলার ঘটনা বাড়তে দেখা যাচ্ছিল। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা থানা পর্যন্ত যায় না, তদন্তও হয় না। আর যদি মামলা হয়ও, তাহলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা দ্রুতই জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং আদালতের বাইরেই মিটমাট করে ফেলেন।

চলতি বছর ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডবের সময় রাজধানী দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত এক কোভিড রোগীর পরিবারের সদস্যরা ভাঙচুর ও হাসপাতাল কর্মীদের লাঞ্ছিত করে। নামকরা হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও অ্যাপোলো এ ঘটনায় আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ আনেনি।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলো অ্যাপোলোর মতোই এ ধরনের ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায় না, যা কর্মীদেরকে আরও বিপদে ফেলে দেয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, তাদেরকে রক্ষায় সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকার কারণেই এ ধরনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে।

“আমরা দেখছি, বিদ্যমান আইন মোটেও কার্যকর নয় এবং যে কারণে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। কঠোর একটি আইন জরুরিভিত্তিতে দরকার, তাহলেই চিকিৎসক পেটালে যে পরিণতি ভোগ করতে হবে তা মানুষ বুঝতে পারবে,” বলেছেন ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) মহাসচিব ড. জয়েশ লেলে।

তিন লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি চিকিৎসকের সংগঠন আইএমএ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর হামলা বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে যাচ্ছে।

তবে অনেকের মতে, কঠোর আইন দিয়ে এসব ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে না।

“এসব হামলা তো পূর্বপরিকল্পিত হয় না, রোগীর মৃত্যুর কারণে তাৎক্ষণিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে হয়। যে কারণে আইন এখানে প্রতিরোধকারী হিসেবে কাজ করবে না,” বলেছেন চিকিৎসকদের ওপর সহিংসতার খোঁজখবর রাখা শ্রেয়া শ্রীবাস্তব।

তিনি ভিধি সেন্টার ফর লিগাল পলিসির একটি গবেষণা দলের সদস্য। এ দলটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসকদের ওপর হামলার ৫৬টি ঘটনা সংক্রান্ত পত্রিকার প্রতিবেদন খতিয়ে দেখে কেন এ ধরনের হামলা হয় আর কীভাবে এগুলো কমানো যাবে তা বের করার চেষ্টা করছে।

শ্রীবাস্তব বলছেন, ভারতের সরকার কোভিড রোগীদের সেবা দেওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলায় সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান চালু করেছে। তবে তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি।

গত বছরের জুনে কোভিডে মৃত এক রোগীর আত্মীয়স্বজন দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর হায়দেরাবাদের গান্ধী হাসপাতালের চিকিৎসক ড. ভিকাশ রেড্ডির ওপর লোহা ও প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। এ ঘটনায় তিনি একটি মামলা করলেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

“কাজে ফের যোগ দেওয়াটা ছিল কষ্টের। আমি ওই একই মেডিকেল কেয়ার ওয়ার্ডে গিয়েছি, সংকটাপন্ন রোগীদের দেখেছি, তখন স্মৃতিপটে হামলার ঘটনা ভেসে উঠতো,” বলেন এই চিকিৎসক।

যা ঘটেছিল, তা নিয়ে বিস্তর চিন্তা করেছেন বলেও জানান ভিকাশ।

“আমি দোটানায় ছিলাম,” বলেন তিনি। পরবর্তী হামলা রোধে চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা কিংবা খারাপ সংবাদ আরও কতটা ভালোভাবে জানানো যায় সে বিষয়টি নিয়েও ভেবেছেন গান্ধী হাসপাতালের এই চিকিৎসক।

 আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাদের আসলে রোগী এবং তার স্বজনদের সময় দেওয়া এবং আমরা কি করতে পারবো আর কি পারবো না, তা তাদেরকে বোঝানো উচিত। কিন্তু আমাদের ওই পরিমাণ সময় থাকে না। প্রতিদিন আমি ২০ থেকে ৩০ জন রোগী দেখি,” বলেছেন তিনি।

বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভারতে রোগী অনুপাতে চিকিৎসক অনেক কম। দেশটিতে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য মাত্র ৯০ জন চিকিৎসক আছেন। এই সংখ্যা চীন (প্রতি এক লাখে ২০০), যুক্তরাষ্ট্র (প্রতি এক লাখে ২৬০) এবং রাশিয়ার (প্রতি এক লাখে ৪০০) তুলনায় অনেক কম।

মহামারী ভারতের এই কম সংখ্যক চিকিৎসকের ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করেছে।

শ্রীবাস্তবদের গবেষণা বলছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলা তখনই হয়, যখন রোগীরা জরুরি বিভাগ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকে, যখন তাদের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় কিংবা যখন রোগীরা মারা যায়। মহামারীতে এ ধরনের পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে।

এরপর আসে ‘আস্থার’ প্রসঙ্গ।

ভারতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার দুই তৃতীয়াংশই অনিয়ন্ত্রিত ও ব্যয়বহুল বেসরকারি খাতের হাতে।

এ ব্যয়বহুল চিকিৎসার পরও কোভিডে লোকজনের মৃত্যু পুরো ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের আস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে চিকিৎসকদের লড়াইয়ের তুলনায় চিকিৎসায় অবহেলার খবর বেশি আসায় মানুষজন আরও সন্দিহান হয়ে উঠছে।

“সর্বোচ্চ যা আমরা করতে পারি তা হলো রোগীকে সেরা সেবাটা দেওয়া। পেশাদার হিসেবে এবং জীবন বাঁচাতে আমরা যে এ পেশাটা বেছে নিয়েছি, সেজন্য সম্মান করলেও সব রোগী বা তাদের পরিবারের কাছে আমরা ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করতে পারি না,” বলেছেন ড. রেড্ডি।