মিয়ানমারে সু চির দলের কর্মকর্তাদের ‘রহস্যজনক মৃত্যু’

মিয়ানমারে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর নিরস্ত্র বিরোধীদের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর নিপীড়ন বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে; দেশটিতে এখন পর্যন্ত যে আটশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয়েছে সামরিক বাহিনীর ছোড়া গুলিতে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2021, 10:48 AM
Updated : 8 June 2021, 10:58 AM

নিহতের এ সংখ্যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকে নাড়া দিলেও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ অব ডেমোক্রেসির (এনএলডি) দুই কর্মকর্তার মৃত্যু দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটির সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের আরও ভীতিকর চিত্র হাজির করছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অং সান সু চির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। এরপর সু চি ও এনএলডির ঊর্ধ্বতন নেতাদের গৃহবন্দি করা হয়।

নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুললেও সেনাবাহিনী এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রমাণ হাজির করেনি। নভেম্বরের ওই নির্বাচনে এনএলডি বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল।

অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারজুড়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়।

বিক্ষোভের মোকাবেলা কীভাবে হবে তা নিয়ে প্রথম ‍তিন সপ্তাহ সামরিক বাহিনীকে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত দেখা গেলেও ফেব্রুয়ারির শেষদিকে এসে তারা বলপ্রয়োগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তারা যে কোনো ধরনের সংযম দেখাবে না, মার্চের প্রথম সপ্তাহেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

ইয়াংগনের মধ্যাঞ্চলীয় পাবেদান এলাকা সেই সময় অনেক নাটকীয় ঘটনার সাক্ষী হয়। নিরাপত্তা বাহিনীকে দূরে রাখতে আন্দোলনকারীরা এলাকার বেশ কয়েকটি রাস্তায় ব্যারিকেড বসায়; কয়েক দফা সংঘর্ষও হয়।

পাবেদান মূলত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা, এখানে আটটি মসজিদও আছে। এখানেই সিথু মংয়ের সংসদীয় আসন।

গত বছরের সংসদ নির্বাচনে এনএলডির যে দু’জন মুসলিম প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন, মং তার একজন। তার নির্বাচনী প্রচার ব্যবস্থাপক খিন মং লাট; কয়েক দশক ধরে এনএলডির সঙ্গে যুক্ত এ ব্যক্তি বহু বছর আগে পাবেদানে চলে আসেন, থাকেন বৌদ্ধ এক আইনজীবীর পরিবারের সঙ্গে।

লাট একটি ট্যুর কোম্পানির মালিকদের একজন ছিলেন, ভিডিও ভাড়া দেওয়ার একটি দোকানও চালাতেন। ১৯৮৮ সাল থেকে এনএলডিতে সক্রিয়, এক পর্যায়ে স্থানীয় শাখার চেয়ারম্যানও হয়ে যান। পুরো এলাকায় তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল।

“তিনি খুবই ধার্মিক ছিলেন, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামজ পড়তেন।কিন্তু সব ধর্মবিশ্বাসীরাই তাকে ভালোবাসতো। শিশুদের খেলাধুলার জন্য নতুন নতুন সবুজ জায়গা তৈরির মতো ওই এলাকার জন্য অনেক কাজ করেছেন তিনি। তিনি এনএলডির কাছেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন,” সামরিক বাহিনীর ভয়ে গা ঢাকা দেওয়া সিথু মং বিবিসিকে এমনটাই বলেছেন।

৬ মার্চ স্থানীয় সময় রাত ৯টার কিছু পরে পুলিশ এবং সেনাসদস্যরা লাট যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে হানা দিয়ে তাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে, একের পর এক লাথি-ঘুষি পড়তে থাকে তার শরীরে।

ওই সেনারা ৭৭ পদাতিক ডিভিশনের সদস্য ছিল বলে পরে প্রতিবেশীরা জানান; মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ বিভাগটি মানবাধিকার লংঘনজনিত কর্মকাণ্ডের জন্য কুখ্যাত।

লাটের বন্ধু কো তুন কাই জানান, সেনাসদস্যরা মূলত এনএলডির জ্যেষ্ঠ নেতা উ মং মং-কে খুঁজছিল, তার বদলে তারা লাটকে নিয়ে যায়।

উ মং মং সেনা অভিযানের আগেই গা ঢাকা দেন।

আটক করার পর লাটকে ইয়াংগনের সিটি হলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে ধারণা কো তুন কাইয়ের; অভ্যুত্থানের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রথম যে কয়েকটি ভবনের দখল নিয়েছিল, ইয়াংগনের এ সিটি হল ছিল তার অন্যতম।

পুলিশ পরদিন সকালে লাটের পরিবারকে ফোন করে ইয়াংগনের উত্তরাঞ্চলীয় একটি সামরিক হাসপাতাল থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে যেতে বলে। লাট অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন বলে তার পরিবারকে জানানো হয়। হার্ট অ্যাটাকে লাটের মৃত্যু হয়েছে বলে অন্যদের জানাতেও বলে দেওয়া হয়।

পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ৫৮ বছর বয়সী লাটে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন এবং তার কোনো অসুখের কথাও তারা জানতেন না।

লাটের মৃতদেহ রক্তে ভেজা একটি কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল এবং শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল বলেও বলছেন তারা।

মৃতদেহে কাটাছেঁড়া এবং সেলাইয়ের চিহ্নও ছিল, যা ময়নাতদন্তের সাক্ষ্য বহন করলেও পরিবারের সদস্যদেরকে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে কোনো প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। সেদিনই মুসলিম রীতি অনুযায়ী লাটকে কবর দেওয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফিজিসিয়ান ফর হিউম্যান রাইটস এনএলডির এ কর্মকর্তার মৃতদেহের বেশ কয়েকটি ছবিসহ এ বিষয়ে পাওয়া তথ্যউপাত্ত খতিয়ে দেখেও মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ বের করতে পারেনি।

পরে তারা লাটের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সামরিক কর্তৃপক্ষের বক্তব্যকে ‘অসঙ্গত’ অ্যাখ্যা দেয়; ৫৮ বছর বয়সী এ রাজনীতিক হেফাজতে নির্যাতনের কারণে মারা যেতে পারেন বলেও ইঙ্গিত দেয় তারা।

তবে কো তুন কিয়ার ধারণা লাটকে ‘ভেবেচিন্তেই হত্যা’ করা হয়েছে।

আটকের ১০ ঘণ্টা পরই পরিবারের সদস্যদের তার মৃত্যুর কথা জানানো হয়, এটা দীর্ঘ সময় ধরে চালানো নির্যাতনের কারণে হয়নি, বলেছেন তুন।

লাটের মৃত্যুর দুইদিন পর এনএলডির আরেক কর্মকর্তা জ মিয়াত লিনের মৃত্যু সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যে ‘টার্গেট’ করে করে এনএলডি কর্মকর্তাদের মারছে- এই তত্ত্বকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।

অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনে লিনের পরিচিতি লাটের চেয়ে বেশি, তার ওপর নির্যাতনের মাত্রাও বেশি ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।

৪৬ বছর বয়সী লিন ছিলেন শিল্পজেলা শুয়ে পাই থারে অবস্থিত নতুন একটি ভোকেশনাল কলেজের পরিচালক, তিনি এনএলডিরও একজন ত্যাগী কর্মী। অভ্যুত্থানের পর তাকে নির্বাসিত আইনপ্রণেতাদের পরিষদ সিআরপিএইচের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে বেছেও নেওয়া হয়।

গ্রেপ্তারের আগের কয়েকদিন তিনি তার ফেইসবুক পেইজে পোস্ট করা একের পর এক বার্তায় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিপ্লবী সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে বাসিন্দাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। লিন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে ‘কুকুর’ ও ‘সন্ত্রাসী’ বলেও অ্যাখ্যা দেন।

“জ মিয়াত লিন ছিলেন রাজনৈতিক পাওয়ারহাউজ। ছিলেন চমৎকার বক্তা। আমাদের এলাকায় তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি জনগণকে একত্রিত করে অভ্যুত্থানবিরোধী প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন,” বলেছেন শুয়ে পাই থারের এক এনএলডি কর্মকর্তা।

সেনাবাহিনীর ভয়ে লুকিয়ে থাকা এ কর্মকর্তা নিজের নাম বলেননি। ৮ মে লিন ও তার ছাত্রদের সঙ্গে এক বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার কথাও স্মরণ করেন তিনি।

“তাকে মোটেও উদ্বিগ্ন মনে হয়নি। এমনকি তিনি আমাকে তার সঙ্গে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাইরে রাস্তায় থাকাটাই আমার জন্য বেশি বিপজ্জনক,” বলেন ওই কর্মকর্তা।

সেদিন সন্ধ্যায় লিন কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে কলেজে ফিরে যান; রাত ২ টার কিছু সময় আগে সেনাসদস্যরা ফটক ভেঙে ওই কলেজে প্রবেশ করে।

ছাত্ররা সেসময় তাদের শিক্ষককে পেছনের দেয়াল বেয়ে পালিয়ে যেতে বলে। সেনাবাহিনী সে রাতের অভিযানে সাত ছাত্রকেও আটক করে।

পরদিন বিকাল ৩টায় লিনের স্ত্রী ফিউ ফিউ উইন স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফোনে স্বামীর মৃত্যুর খবর পান। তাকে বলা হয়, তিনি চাইলে সামরিক হাসপাতালে গিয়ে লিনের মৃতদেহ দেখতে পারেন।

ওই একই সামরিক হাসপাতালেই লাটের পরিবারের সদস্যদেরকেও যেতে হয়েছিল।

লিনের পরিবারের সদস্যরা তার মৃতদেহে অনেক কাটাছেড়াঁ দেখতে পান; তার পেটের অনেকখানি কাটা ছিল, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল।

কর্তৃপক্ষ ফিউ ফিউ উইনকে তার স্বামীর পেছনের দিকে বড় ধরনের একটি ক্ষত দেখান।

রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পরে জানায়, কলেজের পেছনের দেয়াল বেয়ে ওঠার সময় তিনি পেছনের দিকে দুই ইঞ্চি মোটা লোহার পাইপের ওপর পড়ে যান।

লিনের মৃত্যুর বিষয়ে কেউ ভিন্ন কিছু বললে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

ফিজিসিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের (পিএইচআর) চিকিৎসকরা মৃতদেহের ছবি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেন, লিনের মৃত্যু নিয়ে কর্তৃপক্ষের ভাষ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে।

সামরিক কর্তৃপক্ষ ফিউ উইনকে তার স্বামীর শেষকৃত্যের দিন মৃতদেহ হস্তান্তর করে; শেষকৃত্যের আয়োজন করতেও ফিউ উইনের তিনদিন সময় লেগেছিল। এ পুরোটা সময় লিনের মরদেহ হিমশীতল ঘরেও ছিল না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লাট ও লিনের মৃত্যু নিয়ে পিএইচআরের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া চেয়ে সামরিক জান্তার মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও বিবিসির প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর্যন্ত তার কাছ থেকে সাড়া মেলেনি।

কেন এই দুই এনএলডি কর্মকর্তাকে এমন নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে ‘হত্যা’ করা হয়েছে সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

হতে পারে সামরিক বাহিনীর যে ইউনিট তাদেরকে আটক করেছিল, তারা নিজের সিদ্ধান্তেই এ নির্যাতন চালিয়েছে; স্থানীয় বা ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ থেকেও নির্যাতন হতে পারে। এমনকী তাৎক্ষণিক উত্তেজনার কারণেও এমনটা হয়ে থাকতে পারে। রাজনীতিকদের প্রতি ঘৃণাও এ দুই ঘটনায় বড় ধরনের প্রভাব রাখতে পারে।

শুয়ে পাই থারের ওই এনএলডি কর্মকর্তার মতে, লিনকে হত্যা করে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে।

“তাকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করার পেছনে জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করাই কারণ হতে পারে বলে মনে হয় আমার, যেন তারা (জনগণ) পিছু হটে,” বলেছেন তিনি।