লাইন, টোকেন, দালাল: নগদ টাকার সঙ্কটে খাবি খাচ্ছে মিয়ানমার

মিয়ানমারে যদি এখন ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তোলার প্রয়োজন হয়, তাহলে প্রথম বিষয় হল, আপনাকে ঘুম থেকে উঠতে হবে খুব ভোরে।

>>রয়টার্স
Published : 15 May 2021, 05:45 PM
Updated : 15 May 2021, 05:45 PM

কত ভোরে? ব্যাংকগুলোর সামনে টাকা তুলতে আসা মানুষের লাইন শুরু হয়ে যায় ভোর ৪টা থেকেই। সেই লাইনের সামনের দিকে থাকতে না পারলে ভাগ্যে আর সেদিন টাকা নেই।

দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর লাইনে দাঁড়ানো ১৫ থেকে ৩০ জন একটি করে প্লাস্টিকের টোকেন পান। সেই টোকেন দেখাতে পারলে সকাল সাড়ে ৯টার পর ব্যাংকে ঢোকার সুযোগ মেলে।

আপনার হাতে টোকেন না থাকলে ব্যাংকের বাইরের কোনো এটিএম বুথে গিয়ে চেষ্টা করতে পারেন। সেরকম সচল বুথের সংখ্যা হাতে গোনা। আর প্রতিটি বুথের সামনেই থাকে দীর্ঘ লাইন। ফলে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। বুথের মেশিন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা তোলা যায়, যদি মেশিনে টাকা থাকে।

আর তাতে সফল না হলে কালোবাজারে দালাল ধরে ব্যাংকের সেই প্লাস্টিকের টোকেন জোগাড়ের চেষ্টা করা যায়, সেজন্য তাকে মোটা কমিশন দিতে হয়।

মিয়ানমারের এক ডজনের বেশি মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে সেখানকার এমন একটি চিত্রই এখন পাওয়া যাচ্ছে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভুত্থানের পর থেকে দেশটির মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হয়ে উঠেছে নগদ টাকার এই সঙ্কট। জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো কারণ না দেখিয়েই বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংকের জমা টাকা ফেরত না দেওয়ায় নগদ অর্থের এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে।

সেখানে প্রতিদিনই সংঘাতের খবর আসছে। অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ আর ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে অনেক কর্মী ধর্মঘটে যাওয়া্য় ব্যংকগুলো কেবল মাঝে মাঝেই খুলছে। ইন্টারনেট বন্ধ রাখায় অনলাইন লেনদেন করা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক লেনদেনও একপ্রকার বন্ধ হয়ে আছে।

এ সমস্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে সাধারণ নাগরিক আর মিয়ানমারের ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। জান্তার নেতৃত্ব শুরুর পর থেকেই দেশটির অর্থনীতি হয়ে পড়েছে ভঙ্গুর, এক সময়  দ্রুত বেড়ে ওঠা পর্যটন খাতেও ধস নেমেছে। মিয়ানমারের মুদ্রা কিয়াটের মান গত সাড়ে তিন মাসে পড়ে গেছে প্রায় ২০ শতাংশ।

বড় হোটেলগুলোতে শ্যাম্পু আর বিছানার চাদর সরবরাহের ব্যবসা করা হ্নিন হ্নিনের বয়স ২৫ এর আশেপাশে। নগদ টাকার সঙ্কটে তার ব্যবসা চালানোই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীরা এখন ব্যাংক থেকে ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফারের ঝামেলায় যেতে রাজি না। তারা নগদ অর্থ চায়। ফলে আমাদের নগদ টাকাই জোগাড় করতে হয়।”

হ্নিন হ্নিন সেই হাজারো মানুষের একজন, যাদেরকে প্রতিদিন মিয়ানমারের বড় শহরগুলোর হাতেগোনা ক্যাশ মেশিনের বুথের বাইরে টাকা তোলার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়। 

তিনি জানালেন, অনেক সময় লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলো পাঁচজনের ছোট ছোট দল করে একবারে টাকা তোলেন, যাতে একজনের মাধ্যমেই সবার টাকা তুলে নেওয়া যায়।

এটিএম বুথের সামনের এই কষ্টটাই শেষ নয়, ব্যবসার জন্য আরও জটিলতা সামলাতে হয় হ্নিন হ্নিনকে। যেসব পণ্য তিনি বিভিন্ন হোটেলে সরবরাহ করেন, তার বেশ কিছু আসে বিদেশ থেকে। কিন্তু বিদেশের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ থাকায় তাকে এখন হুন্ডির মত একটি পদ্ধতি বের করে নিতে হয়েছে।

থাইল্যান্ডের সরবরাহকারীদের পাওনা শোধ করার জন্য একজন পার্টনারের সহায়তা নিচ্ছেন এই তরুণী। সেই পার্টনার থাইল্যান্ডে তার অ্যাকাউন্ট থেকে হ্নিন হ্নিনের পাওনাদারদের অর্থ শোধ করে দেন। আর হ্নিন হ্নিন মিয়ানমারে সেই পার্টনারকে অর্থ শোধ করেন কিয়াটের নগদ নোটে।

নাগরিকদের এই সঙ্কট নিয়ে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা জান্তা সরকারের কোনো মুখপাত্র কথা বলতে চাননি। কানবাওয়াজা ও সিবি ব্যাংকসহ দেশটির বড় চারটি বেসরকারি ব্যাংককে প্রশ্ন করা হলেও তারা কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হয়নি।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, মার্কিন ডলারসহ অন্যান্য বিদেশি মুদ্রার লেনদেন এখন প্রায় অসম্ভব। দালালরা কালোবাজারিতে নগদ মুদ্রার বিনিময়ে অনলাইনে লেনদেন করলেও ১০ শতাংশেরও বেশি মাশুল রেখে দিচ্ছে।

অবশ্য মিয়ানমারের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্কট আরও পুরনো। ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরসহ চারজন ব্যাংকার রয়টার্সকে বলেছিলেন, এই সঙ্কটের একটি কারণ হল ভালো যোগাযোগ এবং সখ্য আছে এমন গ্রাহকদের ঋণ দেওয়ার প্রবণতা। সেই গ্রাহকরা ঋণের টাকা খুব কমই ফেরত দেয়।

মিয়ানমার বিষয়ে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিচার্ড হোর্সের মতে, অভ্যুত্থান এবং তার প্রতিবাদের মধ্যে দেশটিতে এখন আর স্বাভাবিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা কার্যকর নয়।

তিনি বলেন, “ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আঘাত এসেছে তিনভাবে। একটি হল ব্যাংকগুলোর পুরনো বাজে ঋণের সমস্যা, যার সমাধান করা এখন আরও অনেক বেশি কঠিন। এরপর আছে অভ্যুত্থানের অর্থনৈতিক প্রভাব, যা কার্যত অর্থনীতিকে এক ঝাঁকিতে থামিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি সামলে ওঠার কিংবা প্রণোদনা দেওয়ার মত অবস্থা সেনা শাসকদের নেই। এর সাথে আছে ব্যাংকিং খাতে ধর্মঘটের প্রভাব।”

খাবার আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য মানুষের এমনিতেই মানুষের নগদ টাকা লাগে। আর এখন ব্যাংকিং ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ার শঙ্কাও টাকা তুলতে চাওয়ার একটি কারণ।

ইয়াংগনের একটি ব্যাংকের সামনে টাকা তুলতে আসা মানুষের অপেক্ষা। ছবি: রয়টার্স

দ্বিগুণ হতে পারে দারিদ্র্যের হার

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগদ অর্থের সঙ্কট মিয়ানমারের আরও গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ার একটি স্পষ্ট লক্ষণ।

আর্থিক খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফিচ সলিউশন্স গত এপ্রিলে জানিয়েছে, ২০২১ সালে মিয়ানমারের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) পক্ষ থেকে গত মাসে জানানো হয়, করোনাভাইরাস এবং অভ্যুত্থানের কারণে মিয়ানমার এখন অর্থনৈতিক ধসের মুখে।

২০১৭ সালের একটি প্রান্তিকের হিসাবের সঙ্গে তুলনা করে ইউএনডিপি বলেছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে পাঁচ কোটি ৪০ লাখ মানুষের এই দেশের প্রায় অর্ধেকই আগামী বছরের মধ্যে দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “সঙ্কটের এই ধাক্কায় বিশেষ করে ছোট ব্যবসায় মজুরি এবং আয় অনেক কমে যাবে, খাবারের যোগান এবং মৌলিক চাহিদাসহ সামাজিক নিরাপত্তাও কমে আসবে।”  

গত এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, মিয়ানমারে সামনের মাসগুলোতে ২০ লাখের বেশি মানুষ খাদ্য সঙ্কটে পড়তে পারে।

গত কয়েক সপ্তাহে ব্যাংকের অল্প কিছু কর্মী কাজে ফিরে গেলেও নগদ অর্থের সঙ্কট থেকে খুব দ্রত উত্তরণের কোনো পথ দেখছেন না বিশ্লেষকরা।

দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গনের ব্যবসায়ী খিন রয়টার্সকে বলেছেন, ডিমম তেলসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। ফলে তিনি ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন।

দোকান-পাট কিংবা বাজারে এখনও মুদি মালামাল পাওয়া যাচ্ছে, বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত। তারা বলছেন, জুন মাসে বর্ষাকালীন আবাদের সময় কৃষকরা হয়তে বীজ পাবেন না, নয়ত সেটা কেনার জন্য ঋণ পাবেন না।

খিন বলেন, “প্রত্যন্ত অঞ্চলে এরই মধ্যে চাষাবাদ কমে গেছে এবং পরের মৌসুমে এর বড় প্রভাব পড়বে। শস্য সরবরাহকারী এবং মুরগির খামারিরা এভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত না।”

মিয়ানমারের একজন চাল ব্যবসয়ী, যিনি কয়েকশ কৃষকের কাছ থেকে নিয়মিত চাল কিনে বাজারে সরবরাহ করেন, তিনি বলেছেন, পণ্য সরবরাহের এই ‘চেইন’ এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কৃষকের কাছ থেকে চাল কেনার মত নগদ অর্থ তার কাছে নেই। তার মানে হল, কৃষকের কাছেও বীজ বা কৃষি সরঞ্জাম কেনার কিংবা চাষাবাদের জন্য ক্ষেত মজুরদের দেওয়ার মত নগদ টাকা থাকবে না।

মিয়ানমারের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইয়াঙ্গনে বেসরকারি অনেক ব্যাংক জমিজমা এবং ঘরবাড়ির বিপরীতে ঋণ দিচ্ছে। যদিও অভ্যুত্থানের পর থেকে সেখানে সম্পত্তির দামও পড়ে গেছে।

নিরাপত্তা ঝুঁকির জন্য মিয়ানমারের বেসরকারি ব্যংকগুলোকে গ্রাহকের রাখা অর্থের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। দুজন ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের ব্যাংক দরকারের চেয়েও বেশি জমা রেখেছে কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাড়তি সেই অর্থ তোলার অনুমোদন দিচ্ছে না। ফল গ্রাহককে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

মিয়ানমারের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভ্যুত্থানের পর প্রথম দুই মাস ব্যাংকের শাখাগুলো বন্ধ রাখা হয়েছিল বলে সঞ্চয় তুলে নেওয়ার হিড়িক এড়ানো গেছে।

“এটা ভালো যে শাখাগুলো খোলা ছিল না। যদি শাখাগুলো খোলা থাকত, তাহলে আমাদের কাছে সবার আমানত ফেরত দেওয়ার মত যথেষ্ট টাকা থাকত না।”