কুম্ভ মেলা: একটি উৎসব যেভাবে ভাইরাসকে পৌঁছে দিয়েছে ভারতময়

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে লড়তে থাকা ভারতের হরিদ্বারে গত মাসে লাখ লাখ পুণ্যার্থী যখন কুম্ভ মেলায় সমবেত হলেন, অনেকেই শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2021, 02:24 AM
Updated : 12 May 2021, 02:24 AM

সেই শঙ্কা যে সত্যি ছিল, ধর্মীয় সেই উৎসবই যে দ্রুত গতিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ‘অনুঘটক’ হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ এখন আসছে সংক্রমণের পরিসংখ্যানে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিমালয়ের কোল ঘেঁষা উত্তরাখণ্ডের প্রাচীন ওই শহরে কুম্ভ মেলায় অংশ নিয়ে ফেরা অনেকেরই কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসছে। লাখ লাখ পুণ্যার্থী সেই ভাইরাস পৌঁছে দিয়েছেন ভারতের নানা প্রান্তে।

কুম্ভমেলা শুরুর আগেই ১৫ মার্চ হরিদ্বারে পৌঁছান পুরোহিত মোহন্ত শঙ্কর দাস, তখনই ভারতের বিভিন্ন স্থানে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছিল।

আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসব শুরু হওয়ার চার দিন পর ৪ এপ্রিল ৮০ বছর বয়সী এই ধর্মগুরুর কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসে। তাকে সেসসময় একটি তাঁবুতে কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।

কিন্তু সেখানে আলাদা না থেকে তিনি নিজের যাবতীয় মালামাল আর ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেনে চড়ে এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বারণসীতে গিয়ে নামেন।

ছবি রয়টার্স

রেল স্টেশনে তাকে নিতে এসেছিলেন ছেলে নগেন্দ্র পাঠক। ছেলের সঙ্গে তিনি ২০ কিলোমিটার দূরে পাশের জেলা মির্জাপুরে নিজের গ্রামে ফেরেন একই ট্যাক্সিতে।

মোহন্ত দাস টেলিফোনে বিবিসির সাংবাদিককে বলেছেন, তিনি এখন ‘সুস্থ’ আছেন। কুম্ভমেলা থেকে ফেরার পর নিজের বাড়িতে কোয়ারেন্টিনেই ছিলেন।

এই পুরোহিতের বিশ্বাস, তার মাধ্যমে কারো শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়নি। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তার ছেলে এবং গ্রামবাসী অনেকের মধ্যেই কোভিডের উপসর্গ দেখা দেয়।

কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা তার ছেলে নগেন্দ্র পাঠক বলেছেন, তাদের গ্রামে ১৫ দিনে সর্দি ও জ্বরে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামবাসীর সংক্রমিত হওয়ার সঙ্গে মোহন্ত দাসের সম্পর্ক থাক বা না থাক, অনেক মানুষের সঙ্গে তার ট্রেনে এবং ট্যাক্সিতে ভ্রমণ ‘খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন’ আচরণ হয়েছে। পথে হয়ত তার মাধ্যমে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন।

রোগতত্ত্ববিদ ডা. ললিত কান্ত বলেন, ‘মাস্ক ছাড়া দল বেঁধে নদীর তীরে বসে গঙ্গার নামগানে’ করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ‘আদর্শ পরিবেশ’ তৈরি করেছে। গির্জা কিংবা মন্দিরে সমবেত সংগীতও যে দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর কারণ হয়ে ওঠে, সেটা আগেও দেখা গেছে। 

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০ জনের বেশি শীর্ষ ধর্মগুরু ছাড়াও হরিদ্বারে দুই হাজার ৬৪২ জন্য পুণ্যার্থীর কোভিড- ১৯ পরীক্ষার ফল পজিটিভ এসেছে।   

কুম্ভ মেলা থেকে ফেরার পর পাশের রাজ্য উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব, নেপালের সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র সাহা এবং সাবেক রানী কমল সাহার কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে।

ধর্মীয় এই উৎসব শেষে ফিরে আসার খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে মারা যান বলিউডের নব্বই দশেকর জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক শ্রাবণ রাঠোর। মৃত্যু হয় একই সঙ্ঘে থাকা নয়জন ধর্মগুরু।

ছবি রয়টার্স

সংক্রমণের আশঙ্কায় বেশ কিছু রাজ্যে কুম্ভমেলা থেকে ফিরে আসা পুণ্যার্থীদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। যারা তথ্য গোপন করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার নেয়ারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।   

কোনো কোনো রাজ্যে তাদের আরটি-পিসিআর পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু খুব কম রাজ্যেই ভ্রমণ তথ্যের ডেটাবেইজ আছে। অন্য এলাকা থেকে আসা মানুষকে শনাক্ত করে পরীক্ষা করার প্রমাণ্য ব্যবস্থাও নেই কোনো রাজ্যে।

ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে গত দুই সপ্তাহ ধরেই কুম্ভ মেলা ফেরত পুণ্যার্থীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

গত ২৫ এপ্রিল ভারতের অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’ এর খবরে বলা হয়, রাজস্থানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য কুম্ভমেলা থেকে ফেরা পুণ্যার্থীদের দায়ী করছে কর্তৃপক্ষ।

২০ এপ্রিল ইন্ডিয়া টুডে জানায়, পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশায় কুম্ভমেলায় যাওয়া কমপক্ষে ২৪ জনের কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফল পজিটিভ হয়েছে।  

টাইমস অব ইন্ডিয়া ১৮ এপ্রিল জানায়, গুজরাটে কুম্ভমেলা থেকে ফেরা ১১ শতাংশেরই করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সেখান থেকে আসা একটি ট্রেনে ৩১৩ জন যাত্রীর মধ্যে ৩৪ জনই ছিলেন আক্রান্ত।

১ মে হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্য প্রদেশে কুম্ভমেলা থেকে ফিরে আসা ৬১ জনের মধ্যে ৬০ জনই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। ফিরে আসা আরও ২২ জনকে মরিয়া হয়ে খুঁজছেন কর্মকর্তারা।

ছবি রয়টার্স

এসব ঘটনাকে ‘সর্বনাশা’ হিসেবে বর্ণনা করে রোগতত্ত্ববিদ ডা. ললিত কান্ত বলেন, “এটাতো সাগরে ভাসমান বরফ চাইয়ের কেবল শীর্ষ ভাগ। জনাকীর্ণ বাসে এবং ট্রেনে ঘুরে বেড়ানো এসব পুণ্যার্থীরাই সংক্রমণের সংখ্যা বাড়াতে অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছ।

“আমি কোনো দ্বিধা ছাড়াই এখন বলতে পারি, ভারতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কুম্ভ মেলা একটি প্রধান কারণ।”

বিবিসি লিখেছে, সংক্রমণের ঢেউয়ে শয্যা আর অক্সিজেনসহ জীবরক্ষাকারী ওষুধ না থাকায় হাসপাতালগুলো যখন রোগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছিল, তখন কুম্ভ মেলা বাতিল করলে ভাল হত কিনা জানতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন পুরোহিত মোহন্ত দাস।

তিনি বলেন, “তাহলে সরকার যে পশ্চিমবঙ্গে ভোট এবং নির্বাচনী মিছিল করল- সেটা কি করে সঠিক হয়? তাহলে শুধু আমারা কেন, কেবল ধর্মপ্রাণ ভক্তদেরই কেন বলা হচ্ছে যে সেখানে যাওয়া ভুল হয়েছে?”

সমালোচকরা বলছেন, মোহন্ত দাসের মতো হিন্দু ধর্মগুরুদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় কুম্ভ মেলা বাতিল করতে চাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সবচেয়ে বড় সমর্থক এই সাধুরাই হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করেন।

উৎসবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ দিন গত ১২ এপ্রিল পরিত্রাণের আশায় ৩০ লাখ পুণ্যার্থী যেদিন গঙ্গায় ডুব দিচ্ছিলেন, সেদিন নতুন করে এক লাখ ৬৮ হাজার মানুষের সংক্রমণের মধ্য দিয়ে আক্রান্তের হারে ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থানে ওঠে ভারত।

এক সপ্তাহের মধ্যে প্রধান একজন সাধুর মৃত্যুর পরই কেবল উৎসবের লাগাম টেনে ধরা হয়। কুম্ভ মেলায় জড়ো হওয়া সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতীকীভাবে উৎসব পালনের অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার ততক্ষণে হয়ে গেছে।

ছবি রয়টার্স

গত সপ্তাহে আয়োজকরা জানিয়েছেন, হরিদ্বারে ৯১ লাখ পুণ্যার্থীর আগমন ঘটেছে। যদিও উত্তরাখণ্ড হাই কোর্ট বলেছিল, মহামারীর মধ্যে কুম্ভ মেলার অনুমোদন দেওয়াটা ‘হাস্যকর’।

কুম্ভ মেলার তীব্র ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ ছিল শুরু থেকেই। গত মার্চে সরকারকে সতর্ক করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছিল, ভাইরাসের আরও বেশি সংক্রামক একটি ধরন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এসময় লাখো মানুষকে মাস্ক ছাড়া উৎসবে জড়ো হতে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

উত্তরাখণ্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ত্রিভেন্দ্র সিং রাওয়াত জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই সতর্ক করায় এবারের কুম্ভ মেলা সীমিত আকারে ‘প্রতীকী’ হিসেবে করার পরিকল্পনা হয়েছিল।

“এই উৎসবে শুধু ভারত নয়, অন্যান্য দেশ থেকেও লোকজন আসে। আমার দুশ্চিন্তা ছিল সুস্থ লোকজন হরিদ্বারে এসে সংক্রমিত হয়ে ফিরে গিয়ে সবখানে তা ছড়িয়ে দেবে।”

কিন্তু উৎসবের মাত্র কয়েকদিন আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় তিরাথ সিং রাওয়াতের হাতে। যিনি বলেছিলেন, “গঙ্গা মায়ের আশীর্বাদে এই স্রোতধারায় কোনো করোনা থাকবে না।”

নতুন মুখ্যমন্ত্রী বললেন, কারও থেমে যাওয়ার দরকার নেই। উৎসবে যোগ দিতে কোভিড- ১৯ নেগটিভ প্রতিবেদনও লাগবে না, শুধুমাত্র সুরক্ষা বিধি মানলেই হবে। কিন্তু যখন লাখে লাখে মানুষ আসতে শুরু করল, স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হিমশিম অবস্থা হল কর্মকর্তাদের।

হরিদ্বারের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সম্ভু কুমার ঝা জানিয়েছেন, ভিড় সামলানো ‘খুবই কঠিন’ হয়ে পড়েছিল, তাছাড়া লোকজন কোভিড নেগেটিভ সনদও নিয়ে আসেনি।

বিবিসিকে তিনি বলেন, “পুরোটা পথ বিশ্বাসের ওপর ভর করে আসা এসব ধর্মপ্রাণ মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি। আপনি কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চাওয়া লোকজনকে অপেক্ষায় রাখতে পারবেন?

“কেন্দ্রীয় সরকার এবং হাই কোর্টের পক্ষ থেকে অনুসরন করার জন্য একটি কার্যপ্রণালী (এসওপি) দেওয়া হয়েছে এবং আমরা তার বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।”

উত্তরাখণ্ড ভিত্তিক একটি পরামর্শক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা অনুপ নাউতিয়াল বলেন, “জনতার এতো বড় ঢলকে এসওপি (কার্যপ্রণালী) মানানো প্রায় অসম্ভব।”

তার মতে, এসব বিষয় কাগজেপত্রে দেখতে খুব ভালো, কিন্তু বাস্তবায়ন অসম্ভব।

ছবি রয়টার্স

ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মিলিয়ে তিনি জানান, ২০২০ সালের ১৫ মার্চ এ রাজ্যে প্রথম সংক্রমণ ধরা পরে। এবছর পুণ্যার্থীরা আসতে শুরু করলে ১৪ থেকে ২০ মার্চের মধ্যে সংক্রমিত হন ৫৫৭ জন। উৎসবের শেষ সপ্তাহে ২৫ এপ্রিল থেকে ১ মে শনাক্ত হন ৩৮ হাজার ৫৮১ জন।

“উৎসবের কারণেই সব সংক্রমণ হয়েছে, এমনটা বলা ভুল হবে। কিন্তু এর সঙ্গে সংক্রমণ বাড়ার বিষয়টি মিলেছে।”

সমাবেশের অনুমোদন দিয়ে যে ক্ষতি হয়েছে, তার মাত্রা কমিয়ে আনতে ভারতের করণীয় কি জানত চাইলে রোগতত্ত্ববিদ ললিত কান্ত বলেন, “কেউ একজন বলেছিলেন, পুণ্যার্থীরা করোনাভাইরাসক প্রসাদ (স্রষ্টার আশির্বাদ) হিসেবে গ্রহণ করবে। তাদের মাধ্যমে সব জায়গায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়াটা মর্মান্তিক।”

“পরিস্থিতি শুধরে দেওয়ার মতো কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের জাহাজ সাগরে অনেক দূর ভেসে গেছে। এমনকি আমরা নিরাপদে বন্দরেও ফিরতে পারছি না। এটা খুবই মর্মান্তিক। আমি কেবল প্রার্থনা করতে পারি, সংক্রমণ যেন কমে আসে এবং লোকজন যেন তা পার হতে পারে।”