কোভিড-১৯: বিপর্যস্ত ভারতে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ অবশ্যম্ভাবী, সতর্কবার্তা বিজ্ঞানীদের

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া ভারতে নতুন ঢেউ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করেছেন দেশটির শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2021, 05:32 AM
Updated : 6 May 2021, 08:20 AM

নরেন্দ্র মোদীর সরকারের মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কে বিজয়রাঘবন বুধবার এই সতর্কবার্তা দেন।

এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস উচ্চমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ার কারণে ‘ফেইজ থ্রি’ বা তৃতীয় ঢেউ অবশ্যম্ভাবী। কোন সময়সীমার মধ্যে এটা ঘটবে তা স্পষ্ট নয়।

“তবে নতুন ঢেউয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত।”

শনাক্ত রোগী সংখ্যায় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারতে কোভিড-১৯ একদিনে রেকর্ড ৩ হাজার ৭৮০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

শনিবার দেশটি একদিনে ৪ লাখের বেশি রোগী শনাক্তের কথা জানিয়েছিল। পরের দিন ওই সংখ্যা তিন লাখ ৯২ হাজার ৪৮৮ জনে নামে; সোম ও মঙ্গলে দৈনিক শনাক্ত ধারাবাহিকভাবে কমতে দেখে ‘সংক্রমণ কমছে’ বলে কর্মকর্তারা স্বস্তিও প্রকাশ করেছিলেন।

কিন্তু বুধবার তিন লাখ ৮২ হাজারের বেশি রোগী শনাক্তের সংখ্যা তাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দেওয়ার কথা। দেশের বিভিন্ন শহরে অক্সিজেনের ঘাটতি আর হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভীড়ে এমনিতেই নাকাল স্বাস্থ্য বিভাগ।

সব মিলিয়ে কোভিড-১৯ এ দেশটিতে এ পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে দুই কোটি ৬ লাখ ৬৫ হাজার ১৪৮ জন; সরকারি হিসাবে ভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৮৮ জনের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবেদনে বলেছে, গত সপ্তাহে বিশ্বে করোনাভাইরাসে যত সংখ্যক নতুন সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে, তার অর্ধেকই ভারতে এবং চার ভাগের এক ভাগ মৃত্যুও সেখানেই হয়েছে। 

অনেক রাজ্যে চিকিৎসার অপেক্ষায় থাকা অসংখ্য কোভিড আক্রান্তের মৃত্যু হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে, হাসপাতালের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায়। সৎকারের স্থানগুলো মহদেহের নিরবচ্ছিন্ন মিছিল সামাল দিতে হিমশিম অবস্থায়।

সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকার।

ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে ধর্মীয় উৎসব ও নির্বাচনি সমাবেশগুলোকে ‘সুপার স্প্রেডার’ বা ‘অতিমাত্রায় ছড়িয়ে দেওয়া’ আয়োজন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

মোদীকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে বুকার পুরস্কার জয়ী লেখক অরুন্ধতি রায় লিখেছেন, “আমাদের জন্য বাতাসও ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমরা মারা যাচ্ছি।”

মঙ্গলবার প্রকাশিত এক নিবন্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “এই সংকট আপনারই তৈরি করা। আপনি এর সমাধান করতে পারবেন না। আপনি একে আরও খারাপ দিকেই নিয়ে যেতে পারবেন ... তাই দয়া করে বিদায় নিন।”

লকডাউন ঘোষণায় নারাজ সরকার

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর বাস্তব সংখ্যা সরকারি হিসাবের চাইতে পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি হতে পারে।

মাত্র চার মাসে সেদেশে এক কোটি মানুষ নতুন করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। অথচ ভাইরাসটি সেখানে সনাক্ত হওয়ার পর প্রথম এক কোটি মানুষে সংক্রমিত হতে সময় লেগেছিল ১০ মাস।

বিরোধী দলগুলো দেশজুড়ে আবারও লকডাউন কার্যকর করার আহ্বান জানালেও অর্থনৈতিক ক্ষতি বিবেচনায় সরকার তা করতে রাজি নয়। যদিও বেশ কয়েকটি রাজ্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো পদক্ষেপগুলো নিতে শুরু করেছে। 

এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, যেখানে বিধানসভা নির্বাচনে ভোটাররা নরেন্দ্র মোদীর দলের পক্ষে সমর্থন দেয়নি। নির্বাচনে জিতে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার মহামারী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এর ইমধ্যে রাজ্যে লোকাল ট্রেন চলাচল স্থগিত করেছে এবং ব্যাংক, গয়নার দোকানে কর্মঘণ্টা কমিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে।

সংকটময় মুহূর্তে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত হতে পারে বিবেচনায় ঋণের কিস্তি পরিশোধে সময় বাড়ানোর জন্য বুধবার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

টিকাদান কার্যক্রম ও সংক্রমণ পরীক্ষায় ধীরগতি

টিকা উৎপাদনে ভারত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ হওয়ার পরেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উচ্চহারে বেড়ে চলায় টিকাদানের হার নাটকীয়ভাবে কমে গেছে, যার অন্যতম কারণ সরবরাহ ও পরিবহন সমস্যা। 

মহারাষ্ট্রসহ অন্তত তিনটি রাজ্যে টিকার ঘাটতির কারণে অনেক টিকাদান কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

সরকার বলছে, কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহারযোগ্য ওষুধ রেমডেসিভিরের উৎপাদন তিন গুণ বাড়িয়ে মাসে এক কোটি তিন লাখ শিশি করা হয়েছে, যা এক মাস আগেও ছিল ৩৮ লাখ শিশি।

রাষ্ট্র-পরিচালিত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ জানিয়েছে, দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা ১৫ লাখে নেমে এসেছে, যা শনিবারও ছিলো সাড়ে ১৯ লাখ। 

সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে 

রেলমন্ত্রী পীযুষ গয়াল টুইট বার্তায় বুধবার জানান, তরল অক্সিজেন নিয়ে দুটি বিশেষ ট্রেন রাজধানী নয়া দিল্লিতে পৌঁছেছে। দেশজুড়ে ২৫টিরও বেশি ট্রেন অক্সিজেন সরবরাহের কাজে নিয়োজিত আছে।

সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, অক্সিজেনের সরবরাহ নিয়ে সংকট নেই কিন্তু পরিবহন জটিলতার কারণে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ছে।

এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত আছে।

মিজোরামের মতো মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ভারতের প্রান্তিক রাজ্যের সবচেয়ে বড় কোভিড-১৯ হাসপাতালে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে অন্য সব রোগীকে ছাড়পত্র দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছেন বলে জানালেন সেখানকার কর্মকর্তা ড. জেড আর থিয়ামসাঙ্গা।

তিনি বলেন, “হাসপাতালের ১৪টি ভেন্টিলেটরের মধ্যে মাত্র তিনটি খালি আছে। আমার মতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটি পুরোপুরি লকডাউন অপরিহার্য।”

ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ জানিয়েছে, ভারতের এই সংক্রমণ বিস্ফোরণ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এবং প্রতিবেশী নেপালও এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার সামাল দিতে হিমশিম পরিস্থিতে রয়েছে।

সংস্থাটি বলছে, নেপালে এক মাস আগের তুলনায় এখন সংক্রমণ বেড়েছে ৫৭ গুণ। সেখানে শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ৪৪ শতাংশের দেহেই ভাইরাস ধরা পড়ছে।

ভারতের সীমান্তঘেঁষা শহরগুলো চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর চাপ সামলাতে পারছে না। অথচ দেশটির মাত্র এক শতাংশ জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি টিকা দেওয়া হয়েছে।