শ্রীলঙ্কায় যুদ্ধাপরাধ: জাতিসংঘের নতুন প্রস্তাব চায় ব্রিটেন

শ্রীলঙ্কায় ২৬ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ও ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ নতুন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2021, 09:10 AM
Updated : 23 Feb 2021, 09:10 AM

যুক্তরাজ্য এবং অন্যরা এ সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাবটি এরই মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) সদস্যদের মধ্যে বিলি করেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

সোমবার থেকে জেনিভায় ইউএনএইচআরসির চার সপ্তাহব্যাপী বসন্তকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে। এই অধিবেশনের শেষ দিকেই প্রস্তাবটি গৃহীত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কার বাহিনী এবং তামিল বিদ্রোহী উভয়ের বিরুদ্ধেই বর্বরতা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ওই যুদ্ধ অন্তত এক লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।

“নির্মম ওই গৃহযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সব সম্প্রদায় এক দশক পরও হত্যার শিকার বা নিখোঁজ হওয়া প্রিয়জনদের জন্য ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছে; তাদেরকে এখনও সংঘাত ও সহিংসতার প্রতিক্রিয়াকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে,” বলেছেন দক্ষিণ এশিয়া ও কমনওয়েলথ বিষয়ক ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী লর্ড আহমাদ।

শ্রীলঙ্কা বিষয়ে ইউএনএইচআরসিতে যুক্তরাজ্য নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের যে মূল অংশ আছে তাতে জার্মানি ও কানাডাও সদস্য বলে জানিয়েছে বিবিসি।

লর্ড আহমাদ বলেছেন, জাতিসংঘ শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে নিপীড়ন নিয়ে নতুন প্রস্তাব নিলে তা হবে দেশটির বৈচিত্রপূর্ণ সব সম্প্রদায় ও বিশ্বাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে একধাপ অগ্রগতি।

জাতিসংঘ এবং অন্যান্য দাতা সংস্থার ধারণা, তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে লঙ্কান বাহিনীর যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই ছিল সংখ্যালঘু তামিল বেসামরিক নাগরিক।

২০০৯ সালের মে মাসে তামিল বিদ্রোহীদের গুঁড়িয়ে দিয়ে ২৬ বছরের যুদ্ধের শেষ করে শ্রীলঙ্কা।

ওই গৃহযুদ্ধে লঙ্কান বাহিনী ও তামিল টাইগার উভয়েই বর্বরতা চালিয়ে ছিল অভিযোগ করে আসছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।

যুদ্ধে কয়েক হাজার মানুষ নিখোঁজও হয়েছিল; তামিল বিদ্রোহীদের মধ্যে যারা ধরা পড়েছিল বা আত্মসমর্পণ করেছিল, শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাদেরকে গুম করে ফেলে বলেও অভিযোগ আছে।

তখন থেকেই নিহত, নিখোঁজ তামিলদের পরিবারের সদস্যরা দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে আসছে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার তখনকার সরকার মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তদন্ত এবং বিদেশি বিচারকদের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

ইউএনএইচআরসিতে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে মানবাধিকার লংঘন ও নিপীড়ন নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া আগের প্রস্তাবে বিদেশি বিচারকদের মাধ্যমে বিচার পরিচালনার বিষয়টি ছিল।

সংখ্যাগুরু সিংহলিদের ভোটে জাতীয়তাবাদী একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে নির্বাচনে জেতার কয়েক মাস পর শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোটাবে রাজপাকসে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই প্রস্তাব থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন।

গত বছর তিনি তার সমর্থকদেরকে ‘যুদ্ধের নায়কদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার যুগের’ অবসান হতে যাচ্ছে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। ‘যুদ্ধের নায়ক’ বলতে তিনি মানবাধিকার লংঘনের দায়ে অভিযুক্ত সৈনিকদের ইঙ্গিত করেছিলেন বলেই ধারণা পর্যবেক্ষকদের।

বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতায় থাকাকালে তার প্রতিরক্ষা সচিবের দায়িত্বে থেকে গৃহযুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গোটাবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা ২০০৫ থেকে এক দশক শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

গোটাবে তার নির্দেশে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

“আমাদের সংবিধানের মধ্যে জবাবদিহিতার যেসব রীতি আছে তার কোনোটিকেই বাধা দিচ্ছে না শ্রীলঙ্কার সরকার। আমাদের সংবিধানে বিদেশি বিচারক নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই,” বিবিসিকে এমনটাই বলেছেন শ্রীলঙ্কার বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিনেশ গুনাবর্ধনে।

কেবল জাতিসংঘের প্রস্তাব থেকে নিজেদের প্রত্যাহারই নয় গোটাবে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর আগের সরকারের ‘রাজনৈতিক নির্যাতন’ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশনও গঠন করেছেন।

গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল বাচেলেত বলেছেন, “যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং সবার মধ্যে মিটমাটের অভ্যন্তরীণ উদ্যোগগুলো ফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।”

বাচেলেতের এই প্রতিবেদন কয়েকদিনের মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে জমা দেওয়ার কথা।

শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনারের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।

“কমিশনারের প্রতিবেদনে যা আছে তা মাঠের অবস্থার তুলনায় পুরোপুরি ভিন্ন। এ কারণেই শ্রীলঙ্কা নথি, প্রমাণ ও বিস্তারিত প্রতিবেদনসহ তার সঙ্গে দ্বিমত করছে। শ্রীলঙ্কা তার খসড়া প্রতিবেদনের জবাবও দিয়েছে,” বলেছে তারা।