ওঁৎ পেতে বাঘ, ঝড়-দারিদ্র্য ঠেলছে সুন্দরবনের আরও গভীরে

চার বছর আগে সুন্দরবনের গভীরে গিয়ে আর ফিরে আসেননি পারুল হালদারের স্বামী। মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের খাদ্য হয়েছিল তার শরীর।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Jan 2021, 01:31 PM
Updated : 14 Jan 2021, 03:46 PM

ঝোপঝাড়ের ভেতর তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলেন সঙ্গী দুই জেলেও।

স্বামীর মতো একই পরিণতির শঙ্কা নিয়ে ৪ সন্তানের মা পারুলকেও এখন সুন্দরবনের গভীরে যেতে হচ্ছে; নিত্যদিন নদীতে মাছ ধরেন তিনি। এরপরও মাসে দুইবার মাকে সঙ্গী করে ৬ ঘণ্টা জীর্ণশীর্ণ একটি নৌকা চালিয়ে তিনি চলে যান সুন্দরবনের গভীরে; লক্ষ্য কাঁকড়া ধরা। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সেখানে দিনকয়েক থাকতেও হয় তাকে।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত পারুলের এ ঝুঁকিই ভারত ও বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের নিচু এলাকায় থাকা এক কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ কী ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চাপ মোকাবেলা করছে তার সাক্ষ্য দিচ্ছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। 

এসব এলাকায় এখন কৃষির উপর নির্ভরতা কমছে, বাড়ছে ঘরে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা; পারুলের মতো অনেকে আবার অন্য কোথাও কাজ করতেও যেতে পারছেন না।

বেঁচে থাকার তাগিদে তাদেরকে তাই আরও বেশি করে নির্ভরশীল হতে হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও নদীগুলোর উপর।

“যখন গভীর জঙ্গলে যাই, তখন মনে হয় যেন প্রাণ হাতে নিয়ে গিয়েছি,” মাছ ধরা শেষে ভারতীয় দ্বীপ সাতজেলিয়াতে নিজের তিন কামরার জীর্ণ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে এমনটাই বলেন ৩৯ বছর বয়সী পারুল।

মাছ ও কাঁকড়া ধরে প্রতি মাসে যে ২ হাজার রুপির মতো আয় করেন তার পুরোটাই চলে যায় সংসার ও ছোট মেয়ে পাপড়ির স্কুলের খরচে। মাকে সঙ্গে নিয়ে যে ক’দিন তিনি সুন্দরবনের গভীরে থাকেন সে কয়েকদিন বৃদ্ধ বাবা ও অন্য আত্মীয়স্বজনরা মেয়ের দেখাশোনা করেন। 

“যদি আমি জঙ্গলে না যাই, তাহলে খাবারও জুটবে না,” বলেন পারুল।

১১ বছর বয়সী মেয়ে পাপড়িই তাকে সুন্দরবনে আটকে রেখেছে, মেয়ের জন্য তিনি অন্যত্র কাজের খোঁজে যেতে পারছেন না। কারণ, তিনি চলে গেলে তার সন্তানের যত্ন নেওয়ার যে কেউ নেই। 

“যত কষ্টই হোক না কেন, আমি ওকে (মেয়ে) পড়াবোই,” বলেন পারুল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুন্দরবনের জীবন আরও কষ্টকর হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এখানকার বেশিরভাগ দ্বীপই এখন জোয়ারের সময় পানির নিচে থাকে; বাড়ি ও ফসলের ক্ষেত রক্ষায় সেসব মাটির বাঁধ দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর বেশিরভাগই ভেঙে পড়েছে। 

প্রতিবার ভাঙনে নদীতে যুক্ত হয় আরও মাটি, ক্ষেত ডুবে যায় লবণাক্ত পানিতে; ফসলের ক্ষতি হয়, ধীরে ধীরে জমিগুলো হয়ে পড়ে বন্ধ্যা।

গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের সংখ্যা এবং সেগুলোর তীব্রতার মাত্রাও কয়েকগুণ বেড়েছে।

১৮৯১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তথ্য পর্যালোচনা করে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ক্রান্তীয় ঝড়ের সংখ্যা ২৬ শতাংশ বেড়েছে বলে ২০২০ সালে এনভায়রনমেন্ট, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি জার্নালে প্রকাশিত নয়া দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। 

অবশ্য কেবল সুন্দরবনই নয়, বিশ্বের অনেক এলাকার ক্ষেত্রেই এখন এটা স্বাভাবিক ঘটনা, বলছেন বিশ্লেষকরা।

“সুন্দরবনের পরিবেশের উপর যে নানামাত্রিক আক্রমণের ঘটনা আমরা দেখছি, এমনটা বিশ্বের অনেক উপকূলীয় জলাভূমিতেও ঘটছে বলে ধারণা করছি আমি,” বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম লরেন্স।

গত বছরের মে মাসে সাইক্লোন আম্ফান ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার বেগের বাতাস নিয়ে সুন্দরবনে আছড়ে পড়ে কয়েক ডজন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার বাড়িঘর ও বাঁধ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এরপরও একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী হতে হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষকে।

কুমিরমারি দ্বীপের দক্ষিণ কোণে ভাঙা বাঁধের উপর হাঁটতে হাঁটতে নাগিন মুন্ডা তাকিয়ে দেখছিলেন অক্টোবরে নোনা পানিতে প্লাবিত হওয়া তার আধা একরের ধানক্ষেতকে।

“আমার পুকুরে কোনো মাছ নেই, বাগানে কোনো সবজি নেই; আর আমার ধানের ফসল অর্ধেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে,” বলেন ৫০ বছর বয়সী এ কৃষক।

গত বছর কুমিরমারির প্রায় আড়াইশ একর কৃষিজমি প্লাবিত হওয়ায় দেড় হাজারের বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা দেবাশীষ মন্ডল।

তিনি জানান, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে কুমিরমারির আনুমানিক এক হাজার একর জমি মুছে গেছে, যা দ্বীপটির মোট ভূখণ্ডের ১৫ শতাংশেরও বেশি। এর ফলে ফসলের ক্ষেত আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

“আমরা এটা থামাতে পারছি না। নদী আমাদের জমি খেয়ে ফেলছে,” বলেন মন্ডল।

এই পরিস্থিতিতে জীবনধারণের জন্য অনেককেই যেতে হচ্ছে বনের গভীরে, সাম্প্রতিক সময়ে যেখানে বাঘের আক্রমণে নিহত মানুষের সংখ্যাও কম নয়।

সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের পরিচালক তাপস দাস জানিয়েছেন, গত বছরের এপ্রিল থেকে সুন্দররনের ভারত অংশে বাঘের হাতে অন্তত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

অন্যদিকে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর হিসাব বলছে, গত বছর বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের; আগের দুই বছর এই সংখ্যা ছিল ১৩। 

আসল সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হবে বলেও ধারণা পর্যবেক্ষকদের। জঙ্গলের গভীরে যাওয়া অবৈধ হওয়ায় অনেক সময়ই পরিবারের সদস্যরা এ ধরনের আক্রমণের কথা চেপে যায়, বলছেন তারা।

“বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মানুষের সংঘাত ও হতাহতের যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা খু্বই উদ্বেগজনক,” বলেছেন অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো অনামিত্র অনুরাগ।

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণেও বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যু সংখ্যা বেড়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

মন্ডল পরিবারের মতো সুন্দরবন অঞ্চলের অনেকেই ভারতের বিভিন্ন অংশে দিনমজুরি করে সংসার খরচ যোগাড় করতেন; কিন্তু মহামারীতে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পড়েন বিপাকে। 

সেপ্টেম্বরের শেষদিকে একদিন সকালে কুমিরমারির ৩০ জনের বেশি পুরুষ জঙ্গল অভিমুখে যাত্রা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল- ৩১ বছর বয়সী হরিপদ মন্ডলের মৃতদেহ উদ্ধার করা, মাছ ধরতে গিয়ে যিনি বাঘের আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন।

হরিপদের ওই দুর্ভাগ্যজনক সফরে তার সঙ্গী থাকা জেলেদের দেখানো পথে গিয়ে কুমিরমারির বাসিন্দারা প্রথমে ম্যানগ্রোভ গাছের নিচে একজোড়া লাল মোজা দেখতে পান; নরম কাদামাটিতে টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন অনুসরণ করে এরপর তারা ঢুকে পড়েন বনের আরও গভীরে; বাঘকে দূরে রাখতে লাঠি ঘোরানোর পাশাপাশি পোড়ান আতশবাজি।

“আমিই প্রথম তার মাথা খুঁজে পাই; কিছুটা দূরে মেলে শরীরের বাকি অংশ,” বলেন হরিপদের বড় ভাই সুনীল।

ভাইদের মধ্যে সবার ছোট হরিপদ ওই অঞ্চলের অনেকের মতোই কাজের খোঁজে ছোট থাকতেই স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি দক্ষিণ ভারতে ক্ষেতমজুর আর পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার কাছে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেছেন।

স্ত্রী অষ্টমী ও ৯ বছরের ছেলেকে নিয়ে যে ছোট মাটির ঘরে থাকতেন তার পেছনে ইজারা নেওয়া এক জমিতে ধানও ফলাচ্ছিলেন তিনি। করোনাভাইরাসের কারণে দেশজুড়ে লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার কয়েকদিন আগে ফেরেন বাড়ি। এরপর আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাননি।

কয়েক মাস বাড়িতে বসে থাকার পর টাকার জন্য মরিয়া হরিপদ সিদ্ধান্ত নেন সুন্দরবনের গভীরে গিয়ে মাছ ধরার। একদিন ভোরের আগেই ছাড়েন বাড়ি, নৌকা নিয়ে যান জঙ্গলে, আর ফিরে আসেননি।

“তিনি বলেছিলেন কাছাকাছি কোথাও মাছ ধরে ৫০-১০০ রুপি পেলে তা দিয়ে ঘরের খরচ মেটাবেন। যদি লকডাউন বা করোনাভাইরাস না থাকতো, তিনি হয়তো কাজেই থাকতেন,” বলেন ২৯ বছর বয়সী অষ্টমী।