কেরালার ‘সফলতার গল্প’ শেষ হয়েও হল না যেভাবে

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালা দুই মাস আগেও করোনাভাইরাস মোকাবেলার মডেল ছিল, কিন্তু পরের দুই মাসেই পরিস্থিতি পুরো উল্টে গেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 July 2020, 11:42 AM
Updated : 21 July 2020, 11:42 AM

এখন এই মধ্য-জুলাইয়ে এসে রাজ্যটিতে প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ৮০০ করে রোগী মিলছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

জানুয়ারিতে এ কেরালাতেই ভারতের প্রথম কোভিড-১৯ রোগীর খোঁজ মিলেছিল। মেডিকেল শিক্ষার্থী ওই রোগী ফিরেছিল চীনের উহান থেকে। এরপর থেকে রোগীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে দক্ষিণাঞ্চলীয় এ রাজ্যটি একসময় ভারতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ‘হটস্পটেও’ পরিণত হয়েছিল।

অবশ্য মার্চের মধ্যেই ভারতের আধ ডজন রাজ্যে রোগীর সংখ্যা কেরালাকে টপকে যায়।

এরপর শনাক্তকরণ পরীক্ষা, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত, আইসোলেশন, চিকিৎসা আর তৃণমূলের নেটওয়ার্ককে অসাধারণভাবে কাজে লাগিয়ে মে মাসের মধ্যে কেরালা দৈনন্দিন রোগীর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনে। কেবল তাই নয়, এমনও অনেকগুলো দিন গেছে, যখন রাজ্যটিতে নতুন কোনো কোভিড-১৯ রোগীই পাওয়া যায়নি।

কেরালার এ ‘অনন্য সাফল্য’ দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে, তাদের দক্ষতার কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘মার্ক অব জিরো’ শিরোনামে লেখা দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়তেও। কীভাবে তারা ভাইরাস দমনে সফল হল, তা নিয়ে ভারত এবং ভারতের বাইরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছাপা হল একের পর এক প্রতিবেদন।

“ভাইরাস মোকাবেলায় কেরালা যে অলৌকিক সফলতা অর্জন করেছিল, তা যে বলেছিলাম তাও মনে করতে পারছি আমি,” বলেছেন ভারতের অন্যতম শীর্ষ এপিডেমিওলজিস্ট জয়প্রকাশ মুলিলি।

ওই উদ্‌যাপন যে আগেভাগেই হয়ে গেছে, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। কেরালার প্রথম এক হাজার রোগী শনাক্ত হতে লেগেছিল সাড়ে তিন মাসেরও বেশি সময়, কিন্তু পরবর্তী তিন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে মঙ্গলবার ১৩ হাজার ২৭৪ জনে দাঁড়িয়েছে।

মৃত্যু হয়েছে মোট ৪৩ জনের। হাসপাতাল এবং বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন রাজ্যের এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি বাসিন্দা।

রাজ্যের রাজধানী ত্রিবান্দ্রমের পাশে জেলেদের গ্রাম পুনথুরার ৪ হাজারের মতো পরিবারকে এখন ঘরবন্দি থাকার কঠোর নির্দেশনা মানতে হচ্ছে। কেউই সেখানে ঢুকতে বা সেখান থেকে বের হতে পারছে না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ; চাকা ঘুরছে না পরিবহনের।

লকডাউনের কঠোর নির্দেশনা মানাতে বিভিন্ন সড়কে পুলিশ ও কমান্ডোদের টহল দিতেও দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

চলতি মাসের শুরুতে আরব সাগর তীরবর্তী ঘনবসতিপূর্ণ এ গ্রামটির শতাধিক বাসিন্দার দেহে প্রাণঘাতী করোনাভা্ইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার আগে তাদের কয়েকজন একটি মাছ বাজারেও গিয়েছিলেন; যার ফলশ্রুতিতে ওই অঞ্চলে সংক্রমণের ঊর্ধগতি দেখা যেতে থাকে।

“মানুষ বিভ্রান্ত, বিচ্ছিন্ন ও উত্তেজিত হয়ে পড়ে; হঠাৎই কী হয়ে গেল, তা বুঝে উঠতে পারছে না,” বলেছেন স্থানীয় একটি গির্জার ফাদার বেবিনসন।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে দেখে রাজ্য সরকার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণের কথা স্বীকার করে নিয়েছে। ভারতে প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো রাজ্যের কর্মকর্তাদের এভাবে পরিস্থিতির জটিলতাকে স্বীকার করতে দেখা যায়নি।

“কেরালায় সংক্রমণের সত্যিকারের ঊর্ধ্বগতি এখন দেখা যাচ্ছে। রাজ্যের সীমানা যখন বন্ধ ছিল তখন নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে ভাইরাসকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল,” বলেছেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. লাল সাদাসিভান।

সংক্রমণের এ ঊধ্বগতির পেছনে ভারতজুড়ে দেয়া কঠোর লকডাউন শিথিল হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে কেরালায় ফেরা প্রায় ৫ লাখ শ্রমিকের দিকেই আঙ্গুল তুলছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কেরালার কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৭ শতাংশই রাজ্যের বাইরে কাজ করে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

এ রাজ্যটিতে এখন পর্যন্ত শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৭ হাজারেরও বেশি আক্রান্তের ভ্রমণের ইতিহাস পাওয়া গেছে।

“লকডাউনে ভ্রমণের উপর যে বিধিনিষেধ ছিল, তা যখন তুলে নেওয়া হল, মানুষজন রাজ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে শুরু করল, তখন আক্রান্তের সংখ্যায় লাগাম টানা অসম্ভব হয়ে পড়ল,” বলেছেন ত্রিবান্দ্রম থেকে নির্বাচিত লোকসভা সদস্য শশী থারুর।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে কেরালায় প্রথম যখন বিমানে প্রবাসী শ্রমিকরা ফিরছিলেন, সেসময় কেরালার বামপন্থি মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের সঙ্গে হওয়া কথোপকথনের কথাও স্মরণ করেন তিনি।

“কেবল ভাইরাসের ফিরে আসাতেই নয়, আক্রান্তরা যে বিমানের ভেতরে থাকা অন্য যাত্রীদেরও সংক্রমিত করছিল, তা নিয়েও আক্ষেপ করেছিলেন তিনি। আমার মনে হয় না এটা এড়ানোর কোনো উপায় ‍ছিল। কেননা ভারতের সব নাগরিকেরই দেশে ফিরে আসার অধিকার রয়েছে, এমনকী তিনি যদি অসুস্থ হন তাও। কিন্তু এ ব্যাপারটিই বড় পার্থক্য সৃষ্টি করল,” বিবিসিকে এমনটাই বলেন কংগ্রেস নেতা থারুর।

কেবল ফিরে আসা বাসিন্দারাই নন, ভারতের এ রাজ্যে এরপর থেকে স্থানীয়ভাবে সংক্রমিতদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। মে-র শুরু থেকে ভ্রমণের ইতিহাস নেই এমন রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। রোববারও কেরালায় যে ৮২১ নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে ৬৪০ এরও বেশি রোগী স্থানীয়ভাবে সংক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এদের মধ্যে ৪৩ জনের সংক্রমণের উৎসও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ভারতজুড়ে লকডাউন শিথিলের পর বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসা লোকজন যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন না করায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বলেও মত অনেক বিশেষজ্ঞের।

“মানুষ যখন আবার কাজে যেতে শুরু করে তখন কিছুটা গাছাড়া ভাব প্রত্যাশিতই ছিল। আমরা চেষ্টা করছি, তারা যেন নিরাপদে থাকার চেষ্টা করে সে ব্যাপারে উৎসাহিত করতে,” বলেছেন সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান বি ইকবাল।

সমালোচকদের অনেকে আবার বলছেন, রোগীর সংখ্যা কমে যাওয়ার পর শনাক্তকরণ পরীক্ষা কমিয়ে দেওয়ার কারণেও পরিস্থিতি এরকম জটিল মোড় নিয়েছে।

কেরালায় এখন অবশ্য পরীক্ষার সংখ্যা অনেক বেড়েছে; রাজ্যটিতে এপ্রিলে যেখানে দিনে ৬৬৩টি করে নমুনা পরীক্ষা করা হত, এখন সেখানে হয় ৯ হাজারের বেশি।

আরব সাগর তীরবর্তী এ রাজ্যটিতে প্রতি ১০ লাখ বাসিন্দা অনুপাতে পরীক্ষার সংখ্যা অন্ধ্র প্রদেশ ও তামিল নাডুর চেয়ে কম হলেও মহারাষ্ট্রের তুলনায় বেশি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অন্ধ্র প্রদেশেও শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। তামিল নাডু দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের অন্যতম ‘হটস্পট’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আর মহারাষ্ট্র তো শনাক্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যায় ভারতের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে।