গাড়ির যন্ত্রাংশ দিয়ে ভেন্টিলেটর বানাচ্ছে আফগান মেয়েরা

মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় গাড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে স্বল্প খরচে ভেন্টিলেটর বানানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে আফগানিস্তানের একদল মেয়ে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2020, 08:59 AM
Updated : 22 May 2020, 03:12 AM

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বিশেষ পুরস্কার জিতে কিশোরীদের এ রোবটনির্মাতা দলটি বিশ্ব গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছিল। এখন তারা চলতি মাসের মধ্যেই বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক অনেক কম দামে ভেন্টিলেটর সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে।

বছরের পর বছর যুদ্ধ আর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিপর্যস্ত আফগানিস্তানে তিন কোটি ৮৯ লাখ জনগোষ্ঠীর জন্য চারশর মতো ভেন্টিলেটর আছে বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

দেশটিতে কোভিড-১৯ এ শনাক্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার পেরিয়ে গেছে বলে বৃহস্পতিবার জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে; মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৭ তে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে দেশটির কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে।

“আমাদের চেষ্টার মাধ্যমে আমরা যদি একটি জীবনও রক্ষা করতে পারি, তাই গুরুত্বপূর্ণ,” বিবিসিকে বলেছেন ভেন্টিলেটর বানানোর উদ্যোগ নেওয়া আফগান মেয়েদের দলটির অন্যতম সদস্য ১৭ বছর বয়সী নাহিদ রাহিমি।

‘আফগান ড্রিমার্স’ নামে পরিচিত রোবটনির্মাতা মেয়েদের এ দলটির সব সদস্যই এসেছে হেরাত থেকে। পশ্চিমাঞ্চলীয় এ প্রদেশেই দেশটির প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছিল।

ওই অঞ্চলটি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের অন্যতম উপকেন্দ্র ইরানের কাছাকাছি হওয়ায় হেরাত আফগানিস্তানে নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণের ‘হটস্পটে’ পরিণত হয়।

বিবিসি জানিয়েছে, ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী ‘আফগান ড্রিমার্সের’ সদস্যরা টয়োটা করোলা গাড়ির মোটর এবং হোন্ডা মোটরসাইকেলের চেইন ড্রাইভ ব্যবহার করে ভেন্টিলেটরের একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন।

চিকিৎসাকাজে ব্যবহৃত মানসম্পন্ন ভেন্টিলেটর না পাওয়া গেলে জরুরি অবস্থায় গাড়ির যন্ত্রাংশ দিয়ে বানানো এ ভেন্টিলেটরটি শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া রোগীদের সাময়িক স্বস্তি দেবে বলে দাবি আফগান এ কিশোরীদের।

“এই সময়ে আমাদের নায়ক যারা সেই চিকিৎসক ও নার্সদের সত্যিকারের সহায়তা হবে এমন কিছু করার উদ্যোগ নেওয়া দলের অংশ হতে পেরে আমি সত্যিই গর্বিত,” বলেছেন ‘আফগান ড্রিমার্সের’ দলনেতা সুমাইয়া ফারুকি।

বিবিসি বলছে, বিশ্বজুড়ে সংক্রমণের দ্রুত বিস্তৃতির মধ্যে ভেন্টিলেটরের ঘাটতি এবং তার আকাশচুম্বী দাম সমস্যা সৃষ্টি করছে। চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় একেকটি ভেন্টিলেটরের দাম ৩০ থেকে ৫০ হাজার ডলারের মধ্যে হওয়ায় তুলনামূলক দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে এগুলো কেনা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে আফগান কিশোরীরা জানাচ্ছে, অতিপ্রয়োজনীয় এ যন্ত্রটি বানাতে তাদের খরচ পড়ছে ৬০০ ডলারেরও কম।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় হেরাতজুড়ে লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশপাশি প্রদেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সংগ্রহে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

তবে এরপরও মে মাস শেষ হওয়ার আগেই ভেন্টিলেটর বানানোর কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদী ‘আফগান ড্রিমার্সের’ প্রতিষ্ঠাতা রয়া মাহবুব।

টাইম ম্যাগাজিনের করা বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তিত্বের অন্যতম এ নারী উদ্যোক্তা জানান, তাদের ভেন্টিলেটরের ৭০ শতাংশ কাজই শেষ।

“এখন যেটি ঘাটতি, সেটি হল এয়ার সেন্সরের। সময় বাঁচাতে আমরা এখন এ যন্ত্রাংশটি না বানিয়ে অন্য কোথাও থেকে জোগাড়ের চেষ্টা করছি।

“ভেন্টিলেটর বানানোর প্রথম ধাপ শেষ। হাসপাতালে দুইদিন আগে এটি পরীক্ষা করেও দেখা হয়েছে। আমাদের দল এখন দ্বিতীয় ধাপের কাজ করছে, এ ধাপটি শেষ হলেই আমরা বাজারে ছাড়তে পারবো,” বলেছেন রয়া।

নারী শিক্ষার হার ৩০ শতাংশেরও নিচে, এমন একটি দেশে ভেন্টিলেটর বানানোর মাধ্যমে প্রকৌশল খাতে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে ধারণা বদলাবে বলেই আশা ‘আফগান ড্রিমার্সের’।

“এটি (ভেন্টিলেটর বানানো) মেয়েদের শিক্ষিত করার গুরুত্ব ও সমাজে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ভূমিকা তুলে ধরবে,“ বলেছে নির্মাতা দলের সদস্য ১৬ বছর বয়সী ইলহাম মনসুরি।

আফগানিস্তানের সরকারও তাদের এ প্রকল্পের খোঁজখবর রাখছে বলে রয়া জানিয়েছেন।

“আমাদের প্রকল্পের খোঁজখবর রাখতে এবং সম্ভব সব ধরনের সহায়তা করতে কর্তৃপক্ষকে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দেয়ায় আমরা খুশি,” বলেছেন তিনি।

আফগান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিশোরীদের এ প্রকল্পে সহায়তা করছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।

“আমরা তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু অন্য সব বৈজ্ঞানিক গবেষণার মতো এ ভেন্টিলেটরকেও বেশ কিছু ধাপ পার হতে হবে। যেমন উদ্ভাবন ও সমৃদ্ধকরণ, প্রাক-ক্লিনিকাল গবেষণা এবং যখন এটি বাজারে ছাড়া হবে তখন তার পর্যালোচনা ও অনুমোদন।

“রোগীদের নিরাপত্তাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাবে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের দেয়ার আগে পরীক্ষাগারে বিভিন্ন প্রাণীর উপর প্রয়োগ করে যন্ত্রটির ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে আমাদের,” বলেছেন আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াহিদ মায়ার।