দিল্লির জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আতঙ্কের রাত’

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে দিল্লিতে শিক্ষার্থীদের তুমুল বিক্ষোভের পর পুলিশ জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2019, 10:19 AM
Updated : 17 Dec 2019, 11:12 AM

রোববার সন্ধ্যায় লাঠিচার্জ আর পুলিশের ছোড়া একের পর এক কাঁদানে গ্যাসের শেলের মধ্যেই আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা গ্রন্থাগারের দরজা আটকে বাথরুমের ভেতর লুকিয়ে ছিল।

ভেতরে থাকা এক শিক্ষার্থীর ভিডিও ফুটেজে কয়েক ডজন ছাত্রছাত্রীকে আশ্রয়ের জন্য হুড়োহুড়ি করতে, ডেস্কের নিচে মাথা লুকিয়ে রাখতে এবং পালানোর চেষ্টায় ধাতব, ভাঙা গ্লাস ডিভাইডারের ওপর দিয়ে লাফ দিতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

পুলিশের বর্বরতার চিহ্ন হিসেবে সোমবারও ওই গ্রন্থাগারের মেঝেতে ফোটা ফোটা রক্তের দাগ ছিল, জানিয়েছে আনন্দবাজার।

রোববার বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভের মধ্যে দক্ষিণপূর্ব দিল্লির এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে যে সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে বাঁচতে ৬শ’রও বেশি শিক্ষার্থী ওই গ্রন্থাগার ভবনের ভেতর আশ্রয় নিয়েছিলেন।

পুলিশের হামলায় সন্ধ্যার পর থেকে ওই ভবনটিতে ‘আতঙ্কের রাত’ নেমে এসেছিল।

আনন্দবাজার বলছে, পুলিশের হামলায় গ্রন্থাগারের রিডিং-রুমের প্রায় কোনও কাঁচই আস্ত নেই। মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে চেয়ার-টেবিল। সিসি ক্যামেরা ভাঙা। পেটমোটা বইয়ের পাশে মেঝেতে ইটের টুকরো আর কাঁদানে গ্যাসের শেল। এমনকি নরেন্দ্র মোদী আর অযোধ্যা সম্পর্কিত বই রাখা যে শো-কেসে, তার কাঁচও রেহাই পায়নি অমিত শাহের পুলিশের হাত থেকে।

প্রায় একই ছবি পুরো ক্যাম্পাসে।

“জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার চত্বরে পুলিশি তাণ্ডবের ১২ ঘণ্টা পরে ক্যাম্পাসে পা রেখেও মনে হল, যেন যুদ্ধক্ষেত্র!,” বলেছে তারা।

আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে নিপীড়নের শিকার সংখ্যালঘু, যারা ২০১৫ সালের আগে ভারতে এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দিতে যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেই চলছে তুমুল বিক্ষোভ।

উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লিতেও আইনটির প্রতিবাদে রাস্তায় নামা প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে।

ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আইনটির প্রতিবাদে একের পর এক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।

রোববার জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই প্রতিবাদকারীরা বেশ কয়েকটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়।

পরে এক বিবৃতিতে জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জানান, গাড়িতে আগুন কিংবা পুলিশের ওপর হামলায় তাদের কেউ জড়িত ছিল না। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটিয়েছে বলেও দাবি তাদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক আসাদ মালিক জানান, রোববার প্রায় শতবর্ষ পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মকর্তারা ক্যাম্পাস ফটকে দাঁড়িয়ে পরিচয়পত্র দেখে দেখে শিক্ষার্থীদের ভেতরে ঢুকিয়েছিলেন।

অপরদিকে পুলিশের ভাষ্য, কিছু নাশকতাকারী বিশ্ববিদ্যালয়টির ভেতরে ঢুকে সেখান থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়েছিল; পুলিশ কর্মকর্তারা সেসব নাশকতাকারীকে ধরতেই জামিয়ার ভেতরে হানা দেয়। 

“দুষ্কৃতিকারী ও  উচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়টির ভেতরে ঢুকে পড়েছিল,  তাদের ধরতেই ধাওয়া করেছিল পুলিশ,” সোমবার সাংবাদিকদের এমনটাই বলেন পুলিশের মুখপাত্র এম এস রানধাওয়া।

তার এ মন্তব্যের বিরোধীতা করে মালিক বলেছেন, পুলিশ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছিল, ক্যাম্পাসে তখন কেবল জামিয়ার শিক্ষার্থীরাই ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টির ২২ বছর বয়সী স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সালিহা পিপি জানান, রোববার শতাধিক পুলিশ সদস্য যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের তাড়া করেন, কাঁদানে গ্যাস ছোড়েন এবং লাঠিচার্জ করেন, তখন তিনি ক্যাম্পাসেই ছিলেন।

“একের পর এক কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। যখনই কোনো শিক্ষার্থীকে পাচ্ছিল, তখনই বর্বরভাবে তাকে মারছিল,” বলেছেন তিনি।

জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমা আখতার বলছেন, পুলিশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। হামলায় ২০০র মতো শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম শিক্ষার্থী অধ্যুষিত বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ এখন এ ঘটনা নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানাবে, জানিয়েছেন নাজমা।

“শিক্ষার্থীদের ওপর তারা যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়,” বলেছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর হামলার সময় পুলিশের দলে কোনো নারী সদস্য ছিল না বলে অন্তত পাঁচ শিক্ষার্থী রয়টার্সের কাছে অভিযোগ করেছেন। ভারতের আইন অনুযায়ী, ঘটনাস্থলে কোনো নারী থাকলে তাকে মোকাবিলায় অবশ্যই নারী পুলিশের উপস্থিতি থাকতে হবে।

এসব অভিযোগ বিষয়ে দিল্লি পুলিশের প্রতিক্রিয়া চেয়ে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।