ইছামতির প্রাণ ফেরাতে এক তরুণের পদযাত্রা

স্রোতহারা ইছামতিকে বাঁচাতে সীমান্তের ওপারে নদী তীরের গ্রাম ধরে হাঁটা শুরু করেছিলেন ভারতীয় তরুণ সাবর্ণ সরস্বতী। তাতে সাড়া দিয়ে সাফ হয় কচুরিপানা। তারপর ১৯ বছর পর নৌকা ভাসে নদীয়ায় ইছামতির একটি অংশে।

আইরিন সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2019, 07:41 AM
Updated : 20 Sept 2019, 07:56 AM

২০০০ সালে বন্যার পলি জমে গতি হারাতে থাকে আন্তঃসীমান্ত এই নদী। ধীরে ধীরে ইছামতির বড় একটি অংশ চলে যায় কচুরিপানার গ্রাসে।

বছরের পর বছর স্থানীয়দের কোনো কথাই যখন কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছাচ্ছিল না, ২৬ বছরের তরুণ সাবর্ণ তখন হাঁটতে শুরু করেন। গত জুনে তিনি পায়ে হেঁটে পাড়ি দেন ইছামতি তীরের ৬৫ গ্রাম।

নদীয়া জেলায় নদীর এক তীরের দত্তপুলিয়া গ্রাম থেকে উত্তর ২৪ পরগনার শ্রীপল্লী, অন্য তীরে ঝুপো পেরিয়ে সীতারামপুর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩৫ কিলোমিটার পথে সাবর্ণ সরস্বতীর ‘ইছামতি ওয়াক’ ভারতীয় সাংবাদমাধ্যমের নজর কাড়ে।

আর তাতেই ভারত পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সহায়তায় স্থানীয়দের নিয়ে নদীয়ার নারায়ণপুর থেকে খাগড়াডাঙ্গা গ্রাম পর্যন্ত কচুরিপানা সাফ হয়।

নদীর দূষণ রোধে বাংলাদেশকেও সঙ্গে চান ভারতীয় এই তরুণ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, দর্শনার চিনিকলের বর্জ্যও ইছামতিকে দূষিত করছে।  

ইছামতির ভারতীয় অংশে নদীয়া জেলার দত্তপুলিয়া গ্রাম। সেখানেই সাবর্ণ সরস্বতীর জন্ম, বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই চোখের সামনে ইছামতিকে ধীরে ধীরে কচুরিপানার দখলে চলে যেতে দেখেছেন তিনি। এ যেন একটি নদীর মৃত্যুর পথে যাত্রা।   

সেই দুর্ভোগ তো কেবল নদীর নয়, কচুরিপানার দেয়াল পেরিয়ে নদী পারাপার বন্ধ হয়ে গেল এক সময়। মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে পারছিলেন না, তাদের জীবন, জীবিকাও হুমকিতে পড়ছিল।

সাবর্ণ ভাবলেন, নিজের ইচ্ছেয় চলে বলেই তো নাম ইছামতি। ঘন ঘন বাঁক, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ, এত বেশি বাঁওড়; সে তো ইছামতি বলেই। এ নদীকে তার ইচ্ছার প্রবাহে ফেরানো গেলে তা হবে অভাবনীয় কাজ।

আর সেই কাজে নামার আগে ইছামতিকে আরও ভালোভাবে জানতে চাইলেন সাবর্ণ। সেই জানার আগ্রহ থেকেই মাথায় এল হাঁটার পরিকল্পনা।

“সব থেকে ভালো উপায় আমি নদীর তীর ধরে যদি হাঁটি এবং যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী না থাকার জন্য, মরে যাওয়ার জন্য, মজে যাওয়ার জন্য, সেই মানুষদের কথা যদি জানি।”

ভারতের লোকসভায় সেদিন নতুন এমপিদের শপথ চলছিল। সেদিন ‘পৃথিবীর নামে শপথ’ করে হাঁটতে শুরু করেন সাবর্ণ। আর তখনই বুঝতে পারেন, যতটা কঠিন ভেবেছিলেন, কাজটি হবে আরও অনেক বেশি জটিল। 

“জিওগ্রাফিকালি খুবই ডিফিকাল্ট নদীর পাড় ধরে হাঁটা। রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে নদী। তারপর প্রায় এতটা অংশ ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার… নদীর কাছাকাছি যাওয়াটা মুশকিল।”

সকাল সাড়ে ৫টা বা ৬টা থেকে হাঁটা শুরু করে বেলা ১১টার পর কিছু সময় বিরতি। আবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটা। বন্ধুরা বলছিল, শীতের সময় হাঁটলে কষ্ট অনেক কমত হত। কিন্তু সাবর্ণের উত্তর ছিল, গরমের সময় না হাঁটলে কষ্টটা বুঝবেন কি করে!

“৪১-৪২ ডিগ্রিও ছিল কখনও কখনও। রোদের এত তাপ, মাথা ঘুরিয়ে দিত। জল খাব? গ্রামের দিকে হোটেল পাওয়াটাও মুশকিল।”

তবে শেষ পর্যন্ত ইছামতি ওয়াকে একলা হাঁটতে হয়নি সাবর্ণকে। তার হাঁটা পথে পা মিলিয়েছেন নদী তীরের গ্রামের মানুষও।

“একশ থেকে দেড়শ জনও কোনো কোনো সময় আমার সাথে হেঁটেছেন। আশি-নব্বই বছরের মহিলারা যখন খবর পেয়েছে যে এরকম হাঁটতে হাঁটতে আসা হচ্ছে, তারা আমাকে সম্মান জানিয়েছেন, হেঁটেছেন আমার সাথে অনেকেই। এগুলো অভূতপূর্ব পাওয়া, ভাবা যায় না; অভাবনীয়।”

১৬ জুন শুরু হয়েছিল সাবর্ণ সরস্বতীর ‘ইছামতি ওয়াক’। থেমেছেন ২০ জুলাই। এর মধ্যে অসুস্থতা আর পারিবারিক কাজে সাত দিন হাঁটতে পারেননি। ফেইসবুকে ‘ইছামতি ওয়াক’ নামের একটি পাতায় নিয়মিত হালনাগাদ চলত। মূলত সেখান থেকেই সাবর্ণের হাঁটার কথা বেশি প্রচার পায়।

সাবর্ণ বলেন, ভারত পেট্রোলিয়াম করপোরেশন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে নদীর ১০ কিলোমিটার অংশ থেকে কচুরিপানা তুলে জৈবসার প্রস্তুতির প্রস্তাব দেয়। শ্রীমা মহিলা সমিতি, স্থানীয় মৎস্যজীবী ও রাজ্য সরকারের সহায়তায় ১৬ অগাস্ট থেকে শুরু হয় কচুরিপানা পরিষ্কারের কাজ।

“নদীয়ার নারায়ণপুর থেকে খাগড়াডাঙ্গা গ্রাম পর্যন্ত পানা সাফ হয়েছে।… নৌকাগুলো আবার চলতে পারছে। অভূতপূর্ব একটা দৃশ্য, এত ভাল লাগছে দেখে!”

 

নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সমীক্ষাও চালিয়েছেন সাবর্ণ। অক্টোবরে দুর্গাপূজার পর তা প্রকাশ করবেন, রাজ্য সরকারের কাছেও কপি পাঠাবেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন।

“আমার সার্ভে বিষয়ের মধ্যে ছিল- জিওগ্রাফিকাল কী পরিস্থিতি এই মুহূর্তে, জীববৈচিত্রের কী পরিস্থিতি।… ইছামতি তো মাছের নদী… তো মাছগুলোর কী অবস্থা? যেগুলো মিঠে জলের মাছ, সেগুলোর কী পরিস্থিতি? সেই সাথে ইকোনমিকালি কী অবস্থা আশপাশের মানুষের, সেটা জানার চেষ্টা করেছি।”

একশ বছরের বেশি বয়সী দুই গ্রামবাসীর কাছে সাবর্ণ শুনেছেন, এক সময় ইছামতিতে এত স্রোত ছিল যে সাঁতারে পার হওয়া যেত না।

“নদীতে শুশুক ছিল, কুমির ছিল। আর ছিল প্রচুর স্বাদু জলের মাছ, ল্যাটা-ট্যাটা তো থাকেই, তার সাথে মৌরালা, সেই সাথে চিংড়ি প্রচুর এবং ইলিশ ছিল একটা সময়।”

সাবর্ণ জানান, ইছামতির ভারতীয় অংশে বনগাঁর পরে ড্রেজিং করে কিছুটা গভীরতা ফেরানো গেছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে আলোচনা না করে উৎসমুখে ড্রেজিং করা সম্ভব না।

ভারতের এই তরুণ বলেন, “দর্শনার চিনিকলের জন্য মাথাভাঙ্গা নদী দূষিত হচ্ছে। তার জন্য চূর্নী নদীও দূষিত। মাথাভাঙ্গার দুটো রিভারাইন, একটা হচ্ছে ইছামতি। তো ইছামতিও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। মাথাভাঙ্গায় কোনো মাছ নেই, চূর্নীতে মাছ নেই।”

বাংলাদেশের নদী বাঁচাও আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে সাবর্ণের আহ্বান- “আপনারা একটা গণআন্দোলন বা গণকথা বলুন… একটু রিফাইন করে জলটাকে যেন ফেলে।”

বনগাঁ থেকে অমিতকুমার বিশ্বাস ও তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠানো ভিডিওর ভিত্তিতে ওপারে ইছামতির পরিস্থিতি নিয়ে গত বছর অক্টোবরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তার এক বছরের মাথায় নদীয়ায় নৌকা ভাসার সুখবর জানালেন সাবর্ণ।

 

এই খবরের প্রতিক্রিয়ায় ইছামতি পাড়ের বাসিন্দা অমিতকুমার বিশ্বাস বললেন, “আমার নদীতে নৌকো চলছে, ভালো লাগছে।”

তার ভাষায়, কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ও উপন্যাসের কারণে ইছামতি পরিচিতি পেয়েছে বেশি। কিন্তু দুই দেশের মাঝে পড়ে ‘ফেঁসে’ গেছে এই নদী।

“এটা যদি শুধু বাংলাদেশে যেত, হয়ত বাংলাদেশ ব্যবস্থা করত। এটা যদি ভারতে থাকত, ভারত ব্যবস্থা করত। দুই দেশের মধ্যে থেকে যাওয়ায় এদেশেও উদ্যোগ নিচ্ছে না, ওদেশেও উদ্যোগ নিচ্ছে না। ওদেশের দূষণ এদেশে আসছে। এদেশের দূষণ ওদেশে যাচ্ছে। খুব জটিল পরিস্থিতি।”

ইছামতিকে বাঁচাতে স্থায়ী সমাধানের জন্য দুই দেশকেই সাবর্ণ সরস্বতীর মত এগিয়ে আসার আহ্বান জানান অমিতকুমার।