ঘটনাপঞ্জি: অনিশ্চিতযাত্রার দুই বছর

মিয়ানমারের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে পুলিশের টহল চৌকিতে বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে দুই বছর আগে শুরু হয়েছিল ভয়ঙ্কর সেনা অভিযান। এরপর সেখান থেকে প্রাণ হাতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। কক্সবাজারে তাদের শরণার্থী জীবনের দুর্দশা আর অনিশ্চয়তার দুই বছর পূর্ণ হতে চলেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2019, 09:26 AM
Updated : 23 August 2019, 07:00 PM

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়ন, প্রাণ বাঁচাতে তাদের বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসা, কূটনৈতিক তৎপরতা, রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিতে অং সান সুচি সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ও প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যর্থ চেষ্টার বিষয়গুলো নিয়ে একটি ঘটনাপঞ্জি প্রকাশ করেছে রয়টার্স।

 

২৫ অগাস্ট, ২০১৭: মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) উত্তর রাখাইনের একটি সেনাঘাঁটি ও পুলিশের ৩০টি টহল চৌকিতে হামলা চালায়। দুই পক্ষের সংঘর্ষে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য ও প্রায় ৮০ জন বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রাণ হারান।

২৬ অগাস্ট, ২০১৭: সেনাবাহিনী ও আরসার সংঘর্ষ আরও বিস্তৃত রূপ নিলে রাখাইনের হাজার তিনেক রোহিঙ্গা অধিবাসী নাফ নদী টপকে বাংলাদেশ সীমান্তে চলে আসে বলে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এক কমাণ্ডার জানান।

২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭: অগাস্টের ওই হামলার এক সপ্তাহের মধ্যে উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ২ হাজার ৬০০রও বেশি বাড়িঘর ধূলিস্মাৎ হয়ে যায় বলে দেশটির সরকার জানায়।

১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭: উপগ্রহের ছবি ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খবরের বরাতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানকে পাঠ্যপুস্তকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের যে বর্ণনা আছে ‘একটি উদাহরণ’ হিসেবে অভিহিত করেন।

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭: টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে মিয়ানমারের নেতা অং সান সুচি রাখাইনে মানবাধিকার লংঘনে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসংঘের ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের’ অভিযোগ নিয়ে কিছু বলেননি।

 

১০ অক্টোবর, ২০১৭: ইয়াঙ্গন স্টেডিয়ামে আন্তঃধর্মীয় প্রার্থনার আয়োজন করেন সুচি; একইদিন ১১ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত টপকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে বলে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির বরাত দিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা জানায়।

১২ অক্টোবর, ২০১৭: মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্কট মার্শালের সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাং রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমারের অধিবাসী নয় বলে মন্তব্য করেন।

১৩ অক্টোবর, ২০১৭: বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযানে সেনাসদস্যরা কোনো অপরাধ করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরুর কথা জানায় মিয়ানমার সেনাপ্রধানের কার্যালয়।

২ নভেম্বর, ২০১৭: সেনা অভিযানের পর রাখাইনে প্রথম সফরে সুচি জনগণের উদ্দেশ্যে ‘বিবাদে না জড়াতে’ অনুরোধ জানান।

২৭ নভেম্বর-২ ডিসেম্বর, ২০১৭: পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর করেন। মিয়ানমার সফরে কোনো বক্তৃতায় তিনি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উল্লেখ না করলেও বাংলাদেশে এসে তিনি শরণার্থীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন।

 

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৭: মিয়ানমারের পুলিশ ইয়াঙ্গনে একটি রেস্টুরেন্টে আমন্ত্রণ জানিয়ে রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ওয়া লোন ও কেয়া সোয়ে ও-কে গ্রেপ্তার করে। এ দুই সাংবাদিক তখন রাখাইনের ইন দিন গ্রামে সেনাবাহিনীর হাতে ১০ রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত করছিলেন।

১৮ ডিসেম্বর, ২০১৭: ইন দিনের একটি গণকবর থেকে অজ্ঞাত মৃতদেহ উদ্ধারের কথা জানিয়ে বিবৃতি দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

২১ ডিসেম্বর, ২০১৭: যুক্তরাষ্ট্র ‘মানবাধিকার লংঘনের’ দায়ে মিয়ানমারের ১৩ জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে; এদের মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অভিযান দেখভাল করা জেনারেলও আছেন।

১০ জানুয়ারি, ২০১৮: রয়টার্সের দুই সাংবাদিকের বিচার পূর্ববর্তী শুনানি শুরু। সরকারি কৌঁসুলিরা ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে’ দুইজনের নামে অভিযোগ দায়েরের অনুমতি চান, এ আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছর পর্যন্ত সাজার বিধান রয়েছে। একইদিন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ইন দিনে ১০ রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যায় তাদের কিছু সদস্যের সম্পৃক্ততার দায় স্বীকার করে।

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮: মিয়ানমার অন্তত ৫৫টি রোহিঙ্গা গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে বলে উপগ্রহের ছবির বরাত দিয়ে জানায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। অগাস্টে সেনা অভিযানের পর থেকেই ওই গ্রামগুলো জনশূন্য ছিল।

১২ মার্চ, ২০১৮: রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর ও মসজিদ ছিল এমন এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ঘাঁটি বানিয়েছে বলে জানায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

 

১১ এপ্রিল, ২০১৮: ইন দিনে ১০ রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যায় জড়িত ৭ সেনাসদস্যকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।

৩০ জুলাই, ২০১৮: রাখাইনে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তদন্তে কমিশন গঠন করে মিয়ানমার।

৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮: রয়টার্সের দুই সাংবাদিক দোষী সাব্যস্ত। দেয়া হয় ৭ বছরের কারাদণ্ড।

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮: ভিয়েতনামের হ্যানয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম অন আসিয়ানে অং সান সুচি তার সরকার আরও ভালোভাবে রাখাইন পরিস্থিতি সামলাতে পারতো বলে স্বীকার করে নেন।

১৫ নভেম্বর, ২০১৮: শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রতিবাদের মুখেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র সেসময়ই কোনো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত যেতে চায় না বলে জানায়।

৪ জানুয়ারি, ২০১৯: স্বাধীনতা দিবসে মিয়ানমারের ৪টি পুলিশ চৌকিতে হামলা চালিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মি ১৩ পুলিশ সদস্যকে হত্যা ও আরও ৯ জনকে আহত করে। এ হামলা ওই অঞ্চলে সংঘাত-সহিংসতায় নতুন মাত্রা যোগ করে।

 

১৮ মার্চ, ২০১৯: ২০১৭ অভিযানে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল কিনা তার তদন্তে সামরিক আদালত গঠনের কথা জানায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

৭ মে, ২০১৯: প্রেসিডেন্টের ক্ষমায় মুক্তি পান রয়টার্সের দুই সাংবাদিক।

২৭ মে, ২০১৯: মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র ইন দিনে গণহত্যায় কারাদণ্ডিত ৭ সেনার আগাম মুক্তি অনুমোদিত হওয়ার কথা জানান।

২২ জুন, ২০১৯: মিয়ানমারের কর্তপক্ষ সংঘাতপ্রবণ পশ্চিমাঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বলে জানায় মোবাইল অপারেটর টেলিনর গ্রুপ। সেসময় ওই অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সংঘাত চলছিল।

২০ অগাস্ট, ২০১৯: নতুন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তিন হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিলেও কেউ যেতে না চাওয়ায় তা ভেস্তে যায়।