‘চৌকিদার’ মোদী আরও বিক্রম নিয়ে থাকছেন ক্ষমতায়

সাত ধাপের দীর্ঘ ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার পর বুথ ফেরত জরিপের ফলাফলকে বিরোধীরা পাত্তা না দিলেও সেটাই সত্যি হতে চলেছে; ভারতের মসনদে থাকছেন নরেন্দ্র মোদী এবং আরও শক্তিশালী হয়ে।

মোহাম্মদ আবদুল হালিমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2019, 10:14 AM
Updated : 23 May 2019, 05:47 PM

বিতর্কিত নানা অধ্যায় ছাপিয়ে নিজেকে ‘চায়েওয়ালা’ পরিচয় দিয়ে পাঁচ বছর আগে ভোটের লড়াইয়ে জিতে দিল্লির মসনদে বসেছিলেন মোদী; এবার ভোটের আগে শাসক পরিচয়ের পরিবর্তে নিজেকে ‘চৌকিদার’ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন তিনি।  

বৃহস্পতিবার ভোট গণনায় দেখা যায়, ঐতিহ্যবাহী কংগ্রেস পরিবারের প্রতিনিধি অভিজাত রাহুল গান্ধীর পরিবর্তে ‘চৌকিদার’ মোদীতেই ভরসা খুঁজেছেন ভারতের প্রায় ৯০ কোটি ভোটার।

প্রাথমিক ফল দেখে উচ্ছ্বসিত মোদী বলেছেন, আবারও জিতল ভারত।

“আমরা বেড়ে উঠেছি একসঙ্গে, সমৃদ্ধি এনেছি একসঙ্গে, এক সঙ্গে থেকেই আমরা শক্তিশালী ভারত গড়ব, যা হবে সবার জন্য। ভারত আবারও জিতে গেল,” টুইট লিখেছেন তিনি।

 

ভোটের ফল দেখে সোশাল মিডিয়ায় নিজের একাউন্টের না থেকে ‘চৌকিদার’ শব্দটি ছেঁটে ফেললেও টুইটারে তিনি লিখেছেন, এটা এখন তার অন্তরে স্থান নিয়েছে। 

ভোটের পুরোটা সময় কংগ্রেস এবং আঞ্চলিক দলগুলো মোদীবিরোধী জোয়ার তৈরির চেষ্টা করলেও তা যে কাজে আসেনি তা দেখা যাচ্ছে ফলাফলে।  

ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে তামিলনাড়ুর একটি বাদে সবকটি আসনে এবার নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে সরকার গঠনের জন্য কোনো দল বা জোটকে পেতে হবে ২৭২টি আসন।

দুপুর নাগাদ যে ফল প্রকাশিত হয়েছে, তা দেখলে মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ যে ক্ষমতায় টিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকে না।

তিনশর বেশি আসনে জিতে যাচ্ছে এনডিএ জোট; ২০১৪ সালের চেয়ে বেশি আসন পেতে যাচ্ছে তারা। গতবার শুধু বিজেপির আসন ছিল ২৮২টি, এবার তাদের পদ্মফুল ৩০০’র বেশি আসনে জয়ী হচ্ছে, জোটের আসন ছাড়িয়ে যাচ্ছে সাড়ে তিনশ।

এবার কংগ্রেস নেতৃত্বধীন জোট ইউপিএ ৯০টি আসনে এবং ১১৪টি আসনে অন্যান্য দল জয় পেতে পারে বলে আভাস মিলছে। ২০১৪ সালের চেয়ে কংগ্রেসের আসন বাড়লেও তা মোদীকে হটানোর মতো নয় কোনোভাবেই।

২০১৪ সালে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৪টি আসন, যা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরনো দলটির ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে পরাজয়।  

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ফের জয়ের আভাসে এই কার্টুন নিজেদের ফেইসবুক পাতায় প্রকাশ করে বিজেপি

এবারের লোকসভা নির্বাচনে মোদীকে হারাতে একাট্টা হয়েছিল বিভিন্ন আঞ্চলিক দল, কংগ্রেস তো ছিলই। বিশেষ করে ভোটের প্রচারে রাহুল গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মোদীর কথার লড়াই বেশ জমে উঠেছিল।

কিন্তু সব বাক্যবাণকে পেছনে ফেলে শেষতক মোদী ম্যাজিকেই বাজিমাত। কয়েকটি আসনে হারলেও তার বিজেপি এবং জোট এনডিএই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছে, এই ফলাফলের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, বিজেপির পক্ষে ভোট টানতে মোদী একাই যথেষ্ট।

বিজেপি কর্মীদের কাছে এখন নরেন্দ্র মোদীই সব

যদিও সমালোচকরা বলছেন, মোদী অর্থনীতির যে ব্যাপক উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা কখনোই পূরণ করা সম্ভব তো হবেই না, পাশাপাশি তার নেতৃত্বে ভারতে আরও বেশি ধর্মভিত্তিক মেরুকরণ ঘটবে।

দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে পারিবারিক প্রভাব দূর করার ক্লান্তিকর লড়াই চালিয়ে আসা কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীই এবারের লোকসভা নির্বাচনে মোদীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। কিন্তু তার দলের যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব ছিল না, সে বিষয়ে আগেই আভাস দিয়ে রেখেছিলেন বিশ্লেষকরা।

ভোটের আগে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে কার্যকর জোট গড়তে ব্যর্থতার মধ্যে দিয়েই মূলত শতবছরের বেশি বয়সী দলটির দুর্বলতা পরিষ্কার হয়ে যায়।

গান্ধী পরিবারের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত উত্তর প্রদেশের আমেথিতেই পিছিয়ে পড়েছেন রাহুল; যদিও কেরালার আসনে এগিয়ে তিনি।

বড় দুই দল জিততে না পারলে একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট গঠনে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। বুথ ফেরত বিভিন্ন জরিপে অবশ্য সে সম্ভাবনা একেবারেই উড়ে গিয়ে বিজেপির জয়ের আভাসই মেলে, যদিও মোদী বিরোধী সেই আভাস মানতে নারাজ ছিলেন।

ভারতের লোকসভা নিরবাচনে উত্তর প্রদেশ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে, উত্তর প্রদেশ জয় মানেই পুরো নির্বাচনেই জয়। ২০১৪ সালের মতো এবার অবশ্য উত্তর প্রদেশে বিজেপির একচেটিয়া প্রাধান্য থাকছে না।

উত্তর প্রদেশে মোদীকে ঠেকাতে বহুদিনের তিক্ততা ভুলে বিস্ময়করভাবে একাট্টা হয়েছিল বহুজন সমাজপার্টি (বিএসপি) ও সমাজবাদী পার্টির (এসপি)। মূলত তাদের ‘মহাজোটই’ এবার বিজেপির আসনে ভাগ বসাতে যাচ্ছে।

তবে তা যে মোদীকে ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট হবে না তা ভোটের ফলাফলেই বোঝা যাচ্ছে।

২০১৪ সালে উত্তর প্রদেশের ৮০টি আসনের মধ্যে বিজেপির ছিল ৭১টি। এবার সবশেষ খবর পর্যন্ত উত্তর প্রদেশের ৫৬ আসনে এগিয়ে বিজেপি। বিএসপি ও এসপির জোট ২৩টি এবং কংগ্রেস একটি আসনে এগিয়ে।

যার সঙ্গে মোদীর বাকযুদ্ধ এবার সবচেয়ে বেশি আলোচনার খোরাক হয়েছিল, সেই মমতার পশ্চিমবঙ্গেও এবার গতবারের তুলনায় বলতে গেলে অভাবনীয় ফল এসেছে বিজেপির। মমতার তৃণমূল আর কংগ্রেসের আসনে এবার ভাগ বসাতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি।

এ রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ২০১৪ সালে বিজেপির ছিল দুটি, এবার সেখানে ১৯টি আসন পেতে যাচ্ছে তারা। বিপরীতে মমতার তৃণমূলের আসন কমে আসছে ২২টিতে, গেলবার ছিল ৩৪টি। আর এবার কংগ্রেসের আসন তিনটি কমে একটি হচ্ছে। এ রাজ্যে প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট ২০১৪ সালে ২টি আসনে জিতলেও এবার ফিরছে শূন্য হাতে।

সারাদেশে জয়ের বিপরীতে দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্যের চারটি- অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু ও কেরালায় হারতে হচ্ছে বিজেপির। এসব রাজ্যের ৯১টি আসনের মধ্যে শেষ খবর পর্যন্ত বিজেপি জোটের অর্জন আটটি আসন।

ভোটের ফল দেখে উচ্ছ্বসিত বিজেপি সমর্থকরা

কী আভাস দিচ্ছে ফলাফল

বিজেপি যে নিরঙ্কুশ বিজয় পাচ্ছে, সেটা এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভোটের এই ফলাফল সত্যিকার অর্থে কী আভাস দিচ্ছে?

বিবিসির সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাসের দৃষ্টিতে, প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্যারিশমা এই ফলাফলের মধ্যে দিয়ে অটুট রইল।

“তিনিই বিজেপির পক্ষে তিনিই যে ভোট টানেন সেটা আবারও প্রমাণ হলো। বিজেপিকে ভোট দেওয়া মানেই তাকে ভোট দেওয়া- মোদীর এই মন্তব্য কার্যকর হয়েছে, তা ভোটের ফলাফলেই প্রমাণিত।”    

দ্বিতীয়ত, সাংগঠনিক দক্ষতা, যোগাযোগের সব ধরনের আধুনিক প্রক্রিয়া ব্যবহারসহ বিভিন্নভাবে বিজেপি দল হিসেবে শক্তি অর্জন করেছে, তা এখন অতিক্রম করা যে খুবই কঠিন, যার প্রমাণ ভোটের প্রচারে মিলেছে বলে সৌতিকের মত ।

তিনি বলেন, ভোটের প্রচারে বিজেপি যেভাবে অত্যন্ত কৌশলীভাবে জাতীয়তাবাদ, উন্নয়ন এবং ধর্মীয় মেরুকরণ নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে, তার বিপরীতে বিরোধী দলগুলো কার্যকর বক্তব্য হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে।

“বিজেপির শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে কংগ্রেসকে এখন নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। এজন্য শত বছরের প্রচীন দলটিকে এখন কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি আঞ্চলিক পর্যায়ে দক্ষ নেতা এবং তুণমূলে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে।

“শহর ও গ্রামে কর্মসংস্থানের যে সঙ্কট, সেটা কখনোই ভোটে জেতার জন্য শক্তিশালী বার্তা হতে পারে না, যেখানে মোদী ‘জাতীয়াবাদের’ মতো ভাষা দিয়ে বাজিমাত করেছেন।”

দেড়শ কোটি মানুষের ভাগ্য হাতে নিয়ে ধ্যানে নরেন্দ্র মোদী

মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী

কৃষির সঙ্কট, বাড়তে থাকা বেকারত্ব আর অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ভারতের ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার শঙ্কা- সব মিলিয়ে সম্ভবত অর্থনীতিই হয়ে দাঁবে মূল চ্যালেঞ্জ।

একদিকে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন অন্যদিকে পণ্যৌর দাম কমে যাওয়া- এই দু্‌য়ে ভারতের কৃষি খাতে বিরাজ করছে এক ধরনের স্থবিরতা। বিপুল পরিমাণ ঋণে জড়িয়ে দিশেহারা বহু কৃষক।

মোদীর শাসনামলে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অর্থনীতির দেশটি কিছু ক্ষেত্রে গতিহীন হয়ে পড়েছে। প্রবৃদ্ধি আটকে আছে সাত শতাংশে। তাছাড়া এবছরই সরকারের ফাঁস হয়ে যাওয়া একটি পতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৭০ এর পর দেশে বেকারত্বের হার বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।   

এবারের নিরবাচনকে অনেকেই দেখেছেন ভারতের নিজস্ব পরিচয় এবং সংখ্যালঘুদের জন্য লড়াই হিসেবে। মোদীর গেল পাঁচ বছরে হিন্দু জাতীয়তাবাদই মূল ধারা হয়ে উঠেছে। এ সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা গরু পাচারের অভিযোগ তুলে বহু মুসলিমকে পিটিয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতশাসিত কাশ্মিরে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গ্রুপের আত্মঘাতী হামলায় আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ সদস্য নিহত হওয়ার পর জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।