ধর্মের নগরীতে মোদী জোয়ার

ভারতের হিন্দুদের পবিত্র নগরী হিসেবে পরিচিত বারাণসীতে ভোটারদের মাঝে নরেন্দ্র মোদীরই গুণগান।

সুমন মাহমুদ ভারতের বারাণসী থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2019, 12:38 PM
Updated : 14 May 2019, 01:05 PM

ভারতের সাত পর্বের লোকসভা নির্বাচনের শেষ ধাপে ভোট হবে উত্তর প্রদেশের এই তীর্থ নগরীতে। এখানে বিজেপি নেতা মোদীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কংগ্রেসের অজয় রাই এবং বহুজন সমাজ পার্টি (বসপা), সমাজবাদী পার্টি (সপা) ও রাষ্ট্রীয় লোকদলের (আরএলডি) সমন্বয়ে গঠিত জোটের প্রার্থী শালিনী যাদব।

ভোটের চার দিন আগে শহরের অলি-গলি ঘুরে মন্দির-উপাসনালয়ের পুরোহিত, ক্ষুদ্র দোকানদারসহ নানা পেশার লোকজনের মুখে নরেন্দ্র মোদীর সম্ভাবনার কথাই উঠে এসেছে। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ভিন্ন মনোভাবও রয়েছে, তাদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া মানুষ।

উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল আরএসএস-এর এক সময়ের সদস্য মোদী পাঁচ বছর আগে দিল্লির সিংহাসনে বসার পর পাল্টে গেছে বারাণসীর চিত্র। শহরের রাস্তা-ঘাট এখন অনেক প্রশ্বস্ত, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নও। মন্দির ও তার আশপাশের অলি-গলির সরু রাস্তাগুলোও পাকা করা হয়েছে।

কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের আশপাশের সরু গলিগুলোকে মণিকার্নিকা, ললিতা ও জনসেন ঘাট পর্যন্ত ৫০ থেকে ৭০ মিটার প্রশস্ত করা হয়েছে। বিমানবন্দর ও রেল স্টেশনও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় হোটেল-রেস্টুরেন্ট। বারাণসীতে বিদ্যুতের আলোর ঝলকানিতে হারিয়ে গেছে রাতের অন্ধকার।

এই উন্নয়নই ভোটে মোদীকে এগিয়ে রাখছে বলে মনে করেন বিশ্বনাথ গলির দোকানি শঙ্কর দাশ গুপ্ত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনি যদি পাঁচ বছর আগে এসে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে খটকা লাগছে এই জায়গাটি ওই সময় কেমন ছিল। ঘুরে ঘুরে দেখবেন প্রায় অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। এসব কর্মযজ্ঞের নায়ক বলুন আর প্রশাসক বলুন- তিনি হচ্ছেন মোদীজী। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

“তিনি বারাণসীর ‘পুত্র’। গতবার জিতে তিনি বিশ্বনাথে পুজো করেছেন, আরতি করেছেন। এরপর আরও অনেকবার কমপক্ষে ১০-১১ বার হবে এখানে এসেছেন। ঘন ঘন দিল্লি থেকে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও অফিসারদের পাঠিয়েছেন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তদারকি করতে। নতুন বারাণসীর নির্মাতাকে এখনকার মানুষ শ্রদ্ধা করে।”

বারাণসীর স্থানীয় বাসিন্দা নিতাই গৌরের কাছে ভোটের মাঠে মোদীর অবস্থা কেমন জানতে চাইলে তিনিও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মোদী বন্দনা করেন।

নিতাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লোকসভা নির্বাচনের শেষ দিনে বারাণসীর ভোট। যার শেষ ভালো, তার সব ভালো। আপনি মন্দিরের পাশের অলি-গলিতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন- সংখ্যাগরিষ্ঠরা বলবেন মোদীজীর কথা।

“এটাও তারা বলবেন, বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদী আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। এখানে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।”

মোদী ভক্তরা খুব বেশি আশাবাদী হলেও বিজেপির কাছ থেকে আসনটি ভাগিয়ে নিতে চেষ্টা করছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোও। কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টির কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে।

তাদের বাক্সেও বেশ ভোট পড়বে বলেই মনে করেন পত্রিকা বিক্রেতা অনিল নাথ।

তিনি বলেন, “এই আসনে হিন্দু যাদব সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। সমাজবাদী পার্টির একটি অংশ রয়েছে যারা সাংগঠনিকভাবে খুব শক্তিশালী। দলিত ও যাদব সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে দেখবেন, সেখানে মোদীবিরোধী হাওয়া আছে। তারও কারণ আছে। সেটা হচ্ছে, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বিশাল অংশ যারা কর্মহীন হয়ে আছেন তারা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে।”

রিকশা চালক মন্টু যাদবের কথায় এর প্রমাণও পাওয়া যায়: “আমরা ভালো নেই। এখানকার সাধারণ মানুষজনের সাথে কথা বললে বুঝবেন তাদের দুঃখ-যন্ত্রণার কথা। বড়লোকের অসুবিধা হয় না। দুর্ভোগে পড়েছি আমরা গরিব মানুষ, যারা দিন আনি দিন খাই। আমরা কমলে ছাপ দেব না।”

এস বি বোস নামে বারাণসীর এক ব্যবসায়ী বলেন, “শহরের উপরিকাঠামোর উন্নয়ন হলেও শিল্পে বিনিযোগের পরিমাণ প্রায় শূন্য। কর্মহীন মানুষের সমস্যা গুরুতর আকার নিয়েছে। শহরের আধুনিকায়ন করে তাকে বিশ্ব মানে পৌঁছাতে বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষজনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদকৃতরা এখন কেউ গঙ্গার ঘাটে নৌকা চালায়, কেউ পরিচারিকার কাজ করে, কেউ অন্য পেশায় যুক্ত।

 

“বারাণসীর সাধারণ মানুষ যে খুব একটা সুখে স্বাচ্ছন্দে আছেন এটা বলা যাবে না।”

ভোটে এর প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেখুন বারাণসীতে মোদীজী ব্যাপক জনপ্রিয়। একজন হেভিওয়েট ভিভিআইপি প্রার্থী। তার প্রতিপক্ষ যারা দাঁড়িয়েছেন তারা সে রকম না। আজকে কংগ্রেস ও বহুজন সমাজ পার্টি ও সমাজবাদী পার্টি সবাই মিলে একক প্রার্থী দিলে আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করতাম।

“তাহলে বুঝে নিন, ১৯ তারিখ কী হতে পারে।” 

নরেন্দ্র মোদী

গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে ১৯৫০ সালে জন্ম নরেন্দ্র মোদীর। গুজরাট রেল ক্যান্টিনে চায়ের দোকান ছিল তার বাবার। ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও বিতর্কে তুখোড় ছিলেন মোদী। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতিতে আসেন তিনি।

উগ্র সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের রাজনীতির কারণে বিতর্কিত হলেও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদীর নেতৃত্বেই বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফেরে বিজেপি।

২০১৪ সালে লোকসভার নির্বাচনে গুজরাট থেকে এসে বারাণসীতে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ওই নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছাড়া কারোরই জামানত ছিল না।

কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুজিত সেন বলেন, “বারাণসী উত্তর প্রদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। জাতীয় রাজনীতির বাতিস্তম্ভ বলা হয়ে থাকে এই শহরকে। হিন্দু ধর্ম বলুন, বৌদ্ধ ধর্ম বলুন তাদের সকলের কাছে এই বারাণসীর গুরুত্ব অন্য রকম। নরেন্দ্র মোদী হিন্দুত্ববাদের সেই দর্শনকে নিয়ে রাজনীতিতে এসেছেন।

“সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙক্ষার বিষয়টা বুঝে তিনি (নরেন্দ্র মোদী) অর্থনৈতিক বিকাশ ও জাতীয়তাবাদের শক্তিকে নির্বাচনী প্রচারে কাজে লাগিয়েছেন এবং তাতে তিনি সফল হয়েছেন। এবারও তিনিই সফল হবেন, এখান থেকে লোকসভার সদস্য হবেন।”

আগামী ১৯ মে ভারতীয় লোক সভার সপ্তম পর্বের ভোটের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে বিশাল গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনী কর্মযজ্ঞ। ২৩ মে ভোট গণনা শেষে একসঙ্গে ঘোষণা করার হবে ফলাফল।