শ্রীলঙ্কা হামলা: জাহরান ‘যা করেছেন’, মানতে পারছেন না তার বোন

ভারত মহাসগারের তীরের ছোট্ট শহর কাত্তানকুড়ির বাসিন্দা দুই সন্তানের মা হাশিম মাদানিয়া এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, ইস্টার সানডের সকালে শ্রীলঙ্কায় যে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা ঘটে গেছে, তার পেছনে রয়েছে তারই ভাই।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2019, 04:18 PM
Updated : 25 April 2019, 05:37 PM

বলা হচ্ছে, মাদানিয়ার ভাই মোহাম্মদ জাহরান হাশিম ন্যাশনাল তাওহীদ জামাত (এনটিজে) নামে একটি উগ্রপন্থি ইসলামিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। আর ওই সংগঠনই গত রোববার তিনটি গির্জা ও চারটি পাঁচ তারা হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় বলে শ্রীলঙ্কা সরকারের বিশ্বাস। 

ওই হামলায় নিহতের সংখ্যা সাড়ে তিনশ ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছিল শ্রীলঙ্কা সরকার, পরে তা আড়াইশতে নামিয়ে এনেছে। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৩৯ জন বিদেশি নাগরিক বলে শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

পুলিশ মাদানিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আর মাদানিয়া বিবিসিকে বলেছেন, তার ভাই যা করেছে তাতে তিনি আতঙ্কিত। আর সামনে কী ঘটবে তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত। 

কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, জাহরান হাশিম নিজেও হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এখনও জীবিত আছেন না মারা গেছেন, তা এখনও নিশ্চিত নয়।   

 

বিবিসি লিখেছে, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট মাদানিয়াকে এখন সবার প্রশ্ন আর সন্দেহের দৃষ্টির সামনে অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। তার দাবি, ২০১৭ সালের পর থেকে ভাইয়ের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই।

পরিবারের সবার বড় জাহরানের বয়স ৪০ এর কোটায়। পুলিশ জাহরানের খোঁজ শুরু করায় দুই বছর আগে তিনি নিরুদ্দেশ হন বলে মাদানিয়ার ভাষ্য।  

মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি দল আইএস গত মঙ্গলবার হামলার দায় স্বীকার করে একটি ভিডিও প্রকাশ করে। যেখানে সংগঠনের কালো পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে আইএস নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির নামে শপথ নিতে দেখা যায় আটজনকে।

আইএসের দাবি, ওই আটজনই ইস্টার সানডের দিন আত্মঘাতী হামলায় অংশ নেয়। ওই আট জনের মধ্যে সাত জনের মুখ ছিল ঢাকা। একমাত্র যে ব্যক্তির মুখ সেখানে দেখা গেছে, তিনি জাহরান হাশিম।

শ্রীলঙ্কার পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সেদিন হামলায় অংশ নিয়েছিলেন মোট নয়জন। তাদের মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। তারা সবাই শ্রীলঙ্কার নাগরিক, উচ্চ শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা। তাদের মধ্যে অন্তত একজন যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় আইন পড়েছেন।  

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, হামলাকারীদের মধ্যে ইনসাফ ও ইলহাম নামের দুই ভাই ছিলেন, যাদের বাবা শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত কোটিপতি মোহাম্মদ ইউসুফ ইব্রাহীম।

মসলার ব্যবসা করে ধনী হওয়া ইব্রাহীম শ্রীলঙ্কার গত প্রেসিডেন্টের সময়ে দেশসেবার জন্য সম্মাননা পেয়েছিলেন। হামলার ঘটনার পর শ্রীলঙ্কার পুলিশ ইব্রাহীমকেও গ্রেপ্তার করেছে।

মাদানিয়ার পরিবারের এই ছবি প্রকাশ করেছে শ্রীলঙ্কা মিরর

রোববার অষ্টম আত্মঘাতী বিস্ফোরণটি হয়েছিল ইব্রাহীমের প্রাসাদোপম ভিলায়। গির্জা আর হোটেলে হামলার পর পুলিশ ওই বাড়িতে অভিযানে গেলে এক নারী ওই বিস্ফোরণ ঘটান।

ওব নারী, তার দুই সন্তান ও তিন পুলিশ সদস্য সেখানে নিহত হন। ওই নারী ইব্রাহীমের দুই ছেলের মধ্যে একজনের স্ত্রী বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মাদানিয়া বিবিসিকে বলেছেন, ইস্টার সানডের হামলা আর তাতে জাহরানের ভূমিকা নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা তিনি গণমাধ্যমের খবর থেকেই ‘প্রথম জানতে পেরেছেন’। জাহারান এরকম কিছু করতে পারেন, তা তিনি কখনও ‘কল্পনাও করেননি’।  

“সে আমার ভাই, কিন্তু সে যা করেছে এটা আমি কোনোভাবেই মানতে পারছি না। তাকে নিয়ে আমি আর ভাবতে চাই না।”

তামিলভাষী জাহরান গত বছর তিনেক ধরে কট্টর শরিয়া আইনের প্রচার করে আসছিলেন। নিজের ফেইসবুক ও ইউটিউব অ্যাকাউন্টে ধর্মীয় উসকানিমূলক বিভিন্ন ভিডিও পোস্ট করে আসছিলেন তিনি।

ওই প্রচারের মাধ্যমেই নিজের অনুসারীদের মধ্যে রীতিমত তারকায় পরিণত হন জাহরান। তবে শ্রীলঙ্কায় সংখ্যালঘু মুসলমানদের অনেক সংগঠনই তার কর্মকাণ্ড নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। 

শ্রীলঙ্কার তিনজন মুসলিম নেতা রয়টার্সকে বলেছেন, তারা গত তিন বছরে কয়েকবার জাহরানের বিষয়ে প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, নিজেদের উদ্বেগের কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি।

আইএসের ভিডিওতে জাহরান

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, জাহরান নিরুদ্দেশ হওয়ার পর তার কোনো খোঁজ তারা পাচ্ছিলেন না। আর কাত্তানকুড়ির একজন ইমামের একার পক্ষে গৃহযুদ্ধে বিক্ষত এই দেশের ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম আত্মঘাতী হামলার আয়োজন করা কীভাবে সম্ভব হল, সেটাও ভেবে পাচ্ছেন না অনেকে।

আইএসের সঙ্গে জাহরানের সরাসরি সম্পর্ক ছিল, না তিনি এইএসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজে থেকেই দলবল নিয়ে আনুগত্য স্বীকার করেছেন- সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি এখনও।

মাদানিয়া বিবিসিকে বলেন, “যখন ছোট ছিলাম, আমার ভাই আমার বন্ধুর মতই ছিল। এলাকার মানুষের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু গত দুবছর ধরে তার সঙ্গে আমাদের কারও যোগাযোগ নেই।” 

জাহরানের বাড়ি যে শহরে, সেই কাত্তানকুড়ির কাছেই বাত্তিচালোয়া শহর। ওই শহরের জিয়ন গির্জাতেও ইস্টার সানডের সকালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ২৮ জন নিহত হন।

বিবিসি লিখেছে, মোটামুটি ৫০ হাজার মানুষের শহর কাত্তানকুড়ি এখন পুলিশ, সাংবাদিক- সবারই মনযোগের কেন্দ্রে। স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্বিগ্ন, তাদের বেশিরভাগই জাহরানের বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন না।

কাত্তানকুড়ির মসজিদগুলোর ইমামদের নেতা মোহাম্মদ ইব্রাহিম মোহাম্মদ জুবায়ের বিবিসিকে বলেন, “আমাদের এলাকার কেউ ওই হামলার সঙ্গে জড়িত, এটা আমাদের জন্য মোটেও ভালো কোনো খবর না। আমরা বিস্মিত, উদ্বিগ্ন। আমাদের দেশ উগ্রপন্থিদের সমর্থন করে না। আমরাও ঐক্য আর সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করি।”

জুবায়ের জানান, জাহরানের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর আগে তার ইসলামের নীতি আর বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু তাদের মত মেলেনি।  স্থানীয় তরুণদের উগ্রপন্থার দিকে ঝোঁকার বিষয়টি স্থানীয়রাও ভালোভাবে নেয়নি। 

জাহরানের গড়ে তোলা মসজিদ এখন ফাঁকা। ছবি: বিবিসি

মাদানিয়া জানান, তার ভাই বাগ্মীতার গুণে দ্রুত কিছু লোকের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পরিচিতি বাড়ার পর আশপাশের এলাকাতেও তিনি ওয়াজ করতে শুরু করেন।  

কিন্তু কট্টরপন্থি বক্তব্যের কারণে মূল ধারার ইসলামিক সংগঠনগুলো জাহরানকে তাদের মাহফিল বা খুতবায় ডাকা বন্ধ করে দিলে তিনি নিজেই একটি সংগঠন খুলে ফেলেন।  আর সেই সংগঠনই হল ন্যাশনাল তাওহীদ জামাত-এনটিজে।

কাত্তানকুড়ির সৈকতের কাছেই একটি মসজিদ গড়ে তোলেন জাহরান। সেখানেই নিজের উগ্রপন্থি প্রচার চালাতে থাকেন তিনি।

স্থানীয়দের বারত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, সোশাল মিডিয়ায় উগ্রপন্থি প্রচারের কারণে এক পর্যায়ে জাহরানকে বহিষ্কার করে তার দল। এরপর তিনি এলাকা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ঠিকই তার জঙ্গি মতবাদের প্রচার চলতে থাকে।

ফলে এনটিজে আসলেই জাহরানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে স্থানীয়দের কারও কারও মধ্যে। 

মাদানিয়া বিবিসিকে বলেছেন, ইস্টার সানডের হামলার কয়েক দিন আগে থেকে তার বৃদ্ধ বাবা-মাও নিরুদ্দেশ। এর পর থেকে তাদের সঙ্গেও তার কোনো যোগাযোগ নেই।

“তাতে আমার মনে হয়েছে, আমার ভাইয়ের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে।”