কলম্বো থেকে এক ঘণ্টা দূরের এ বন্দর শহরে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সম্প্রদায় মিলেমিশে বাস করলেও গত কয়েকদিনে সেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা অনেক বেড়ে গেছে, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রোববার স্থানীয় সময় সকালে ভারত মহাসাগরের এ দ্বীপদেশটির বিভিন্ন গির্জা ও হোটেলে একযোগে যে বোমা হামলা হয়, তার মধ্যে নেগোম্বোর সেইন্ট সেবাস্টিয়ান চার্চও ছিল।
প্রায় একই সময়ে ছয়টি স্থানে বিস্ফোরণ ঘটলেও এ গির্জাটিতে হওয়া হামলাই ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী।
ইস্টার সানডের ওই হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৫৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সেইন্ট সেবাস্টিয়ানেই মৃতের সংখ্যা ২০০-র কাছাকাছি হবে বলে ধারণা গির্জার নেতাদের।
ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণের পর থেকেই নেগোম্বোর মুসলমানরা স্থানীয়দের কাছ থেকে ‘প্রতিশোধের হুমকি’ পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
বুধবারও কয়েকশ পাকিস্তানি মুসলমান কলম্বোর উত্তরের এ শহরটি ছেড়ে পালিয়ে যান বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
স্থানীয় নেতা ও পুলিশ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকা ওই মুসলমানদের সরিয়ে নিতে বাসেরও ব্যবস্থা করে দেন।
“বোমা হামলা এবং এখানে যে বিস্ফোরণটি হয়েছে তার কারণে স্থানীয় শ্রীলঙ্কানরা আমাদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে। এ মুহুর্তে আমরা জানি না, আমরা কোথায় যাচ্ছি,” বাসে উঠতে উঠতে বলছিলেন পাকিস্তান থেকে আসা আদনান আলি।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করেছে।
এ জঙ্গিগোষ্ঠীটি ইসলামের সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী, অন্যদিকে নেগোম্বো ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মুসলিম শরণার্থীর বেশিরভাগই আহমদিয়া মতাদর্শের।
পাকিস্তান আহমদিয়াদের ‘অ-মুসলিম’ ঘোষণার পরপরই এ মুসলমানরা সেখান থেকে পালিয়ে শ্রীলঙ্কায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। রোববারের হামলা তাদেরকে ফের উদ্বাস্তুতে পরিণত করল, ঠেলে দিল অনিশ্চিত জীবনের দিকে।
এদেরই একজন ফারাহ জামিল। রোববারের ঘটনার পর যাকে তার বাড়িওয়ালা বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন।
“তিনি আমাকে বলেছেন- বেরিয়ে যাও; যেখানে খুশি সেখানে চলে যাও, কিন্ত এখানে থেকো না,” নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে যেতে আহমদিয়া মসজিদের সামনে অন্যদের নিয়ে অপেক্ষা করার সময় রয়টার্সকে এমনটাই জানান এ নারী।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ধারাবাহিক সতর্ক বার্তা পাওয়ার পরও ভয়াবহ এ হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতায় শ্রীলঙ্কার সরকারও অনেকটাই বেসামাল হয়ে পড়েছে।
২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার যে পশ্চিমাঞ্চল মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা দেখেছিল, হামলার পর সেখান থেকে অসংখ্য মানুষকে আটক করা হয়েছে। সেইন্ট সেবাস্টিয়ান চার্চের আশপাশের এলাকাগুলোতেও চলছে একের পর এক তল্লাশি।
শরণার্থীদের দিক থেকে কোনো ধরনের হুমকি নেই জানালেও পুলিশ বলছে, নেগোম্বোর পাকিস্তানিদের নিয়ে স্থানীয়দের সন্দেহকে কেন্দ্র করে আসা বিপুল পরিমাণ ফোনে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।
“মানুষের সন্দেহ হলে আমাদের বাড়িঘরে তল্লাশি চালাতে হবেই,” বলেছেন কাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেরাথ বিএসএস সিসিলা কুমারা।
অজ্ঞাত এক স্থানে পাঠিয়ে দেওয়ার আগে মসজিদে জড়ো হওয়া ৩৫ পাকিস্তানিকে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই ওই থানার পুলিশি হেফাজতে নিয়ে আসা হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
“সব পাকিস্তানিকে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারাই ঠিক করবেন- কখন তারা ফিরবেন,” বলেছেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
দুই কিলোমিটার দূরেই সেইন্ট সেবাস্টিয়ান চার্চের সমাধিক্ষেত্রে শোভা পাচ্ছে নতুন সব সমাধির পাশে দণ্ডায়মান কাঠের ক্রুশ। ইস্টার সানডের হামলায় নিহতদের মধ্যে বুধবার পর্যন্ত ৪০ জনের মরদেহ এখানে শায়িত হয়েছে।
বিস্ফোরণে নয় বছরের মেয়ে মিরানহি ও স্ত্রী চন্দ্রলতা দাসানায়েকেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় চান্না রেপুনজায়া। ৪৯ বছর বয়সী এ ব্যক্তি সেদিন ঘরেই ছিলেন।
“যখন তাদের মৃত্যুসংবাদ পাই মনে হচ্ছিল আত্মহত্যা করি। আমার এখন কিছুই নেই,” বলেন চান্না।
নয় বছর বয়সী মিরানহিকে যখন ছোট কফিনে শোয়ানো হচ্ছিল, তখন তার দাদিকে একজন ধরে রেখেছিলেন। হামলায় আহত ওই নারীর মাথায় তখনো ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল।
শ্রীলঙ্কার দুই কোটি ২০ লাখ অধিবাসীর অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও এখানে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টানদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের সঙ্গে বৌদ্ধদের বেশ কয়েকবার দাঙ্গা হলেও খ্রিস্টানরা সাধারণত এ ধরনের উত্তেজনার বাইরেই থাকতো।
শরণার্থীদের বরণ করে নেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে নেগোম্বোর। ২০০৪ সালের ভয়াবহ সুনামিতে যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছিল, তাদেরও স্থান হয়েছে এখানে।
কিন্তু রোববারের হামলার পর সেই ঐতিহ্য বজায় থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
“মুসলিম আর ক্যাথলিকরা এখানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকতো। সবসময় এটি ছিল শান্তিপ্রিয় অঞ্চল; কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আমরা যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না,” বলেছেন বুধবারের শেষকৃত্যে অংশ নেওয়া যাজকদের একজন ফাদার জুড থমাস।