শ্রীলঙ্কার পর্যটনে বোমা হামলার ধাক্কা

ইস্টার সানডের প্রার্থনার মধ্যে একাধিক গির্জা ও হোটেলে বোমা হামলায় তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যুতে শ্রীলঙ্কা ঘিরে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক, যাতে দ্বীপ দেশটিতে ভ্রমণে ইচ্ছুক পর্যটকরা এখন পিছু হটতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

>>রয়টার্স
Published : 23 April 2019, 01:48 PM
Updated : 23 April 2019, 03:20 PM

ট্রাভেল বুকিং ওয়েবসাইট ফার্স্ট চয়েসে পোস্ট করা একটি টুইটে অবকাশযাপনকারীদের মধ্যকার উদ্বেগ উঠে এসেছে। এদিকে যারা কিছু দিনের মধ্যে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের জন্য বুকিং দিয়েছিলেন তারা এখন তা বাতিল করলে তার জন্য নির্ধারিত ফি ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স ও ট্রাভেল এজেন্ট।

জুডিথ অ্যান ক্লেটন নামের একজন পর্যটক টুইটারে লিখেছেন, “ছুটি কাটাতে দেশটি ভ্রমণে যারা বুকিং দিয়েছিলেন তারা এখন কী করছেন?

“স্পষ্টত সেখানে যাওয়া এখন সবার জন্য অনিরাপদ।”

তবে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের প্রস্তুতি নেওয়া অনেকে বলছেন, তারা তা বাতিলের জন্য লাইন ধরবেন না। 

জন কারমুচে নামের একজন ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “সন্ত্রাসীদের কাছে ছেড়ে দিচ্ছি না। তোমাদের প্রয়োজনের সময় আমরা তোমাদের পাশে থাকতে চাই। আমাদের ভ্রমণ বাতিল করার মতো কোনো বার্তা দেবেন না।”

অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ট্রাভেল গাইড লৌনলি প্ল্যানেট এ বছর স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করার মতো পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে বাছাই করেছিল। এক দশক আগে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের পর পর্যটকদের কাছে ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় স্বর্গ’ হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি তৈরিতে সক্ষম হয়েছিল শ্রীলঙ্কা।

কলম্বোর গল ফেস সৈকতের কাছে কয়েকটি পাঁচ তারকা হোটেল। ২৮ মার্চ তোলা ছবি। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

শ্রীলঙ্কার পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশটি ভ্রমণ করেন ২৩ লাখ পর্যটক, যা ২০০৯ সালের তুলনায় ৪০০ শতাংশ বেশি।

দ্রুত বিকাশমান পর্যটন খাত থেকেই শ্রীলঙ্কার তৃতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। ২০১৮ সালে এ খাত থেকে তাদের আয় প্রায় ৪৪০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। 

তবে ৩৫ বিদেশিসহ তিন শতাধিক মানুষের প্রাণ নেওয়া এই আত্মঘাতী হামলা কিছু সময়ের জন্য হলেও শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পের এই প্রবৃদ্ধিকে থমকে দিল।

ওই দিনের হামলায় ডেনমার্কের ধনকুবের অ্যান্ডার্স হলচ পভলসেন ও তার স্ত্রী তাদের চার সন্তানের তিনজনকে হারিয়েছেন। কলম্বোর একটি হোটেলে বিস্ফোরণে মারা যান তারা। সকালের নাস্তার সময় বিস্ফোরণে প্রাণ হারান এক ব্রিটিশ মা ও তার ছেলে। হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন দুই অস্ট্রেলিয়ানও।

বাংলাদেশ থেকে ঘুরতে গিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে কলম্বোরই একটি হোটেলে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের মেয়ে-জামাতা। সকালে হোটেলটির রেস্তোরাঁয় বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের এক সন্তান, গুরুতর আহত হয়েছেন বাবা।

ভয়ানক এই হামলার পর শ্রীলঙ্কা ত্যাগের উদ্দেশে কলম্বো বিমানবন্দরে ভিড় জমানোদের চেহারায় ছিল স্বস্তির ছাপ।

কলম্বোর গল ফেস সৈকতের কাছে কয়েকটি পাঁচ তারকা হোটেল। ২৮ মার্চ তোলা ছবি। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

স্কুল ক্রিকেটারদের নিয়ে ট্যুরে আসা ব্রিটিশ শিক্ষক জেমস টার্নার বলছিলেন, “দেশ থেকে প্রচুর মেসেজ আসছে।”

এরমধ্যেও অনেক পর্যটক শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছেন। তবে তারা সবাই দ্রুত রাজধানী ছাড়ছেন।

দুই সন্তানকে নিয়ে অবকাশ যাপনে যাওয়া ব্রিটিশ নাগরিক রুথ অ্যাডামস বলেন, “আমরা সোজা কলম্বো ছেড়ে যাচ্ছি।”

শ্রীলঙ্কায় আরও সন্ত্রাসী হামলার শঙ্কা জানিয়ে নাগরিকদের দেশটি ভ্রমণে সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।

তারা বলেছে, “সামান্য আভাস বা কোনো আগাম সতর্কবার্তা ছাড়াই সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে।”

হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হিসেবে পর্যটন কেন্দ্র, শপিং মল, হোটেল, বাস ও রেল স্টেশন, বিভিন্ন প্রার্থনা কেন্দ্র, বিমানবন্দর ও জনসমাগমপূর্ণ এলাকার কথা বলা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার তৃতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আসে পর্যটন থেকে। কলম্বোর গল ফেস সৈকতে পর্যটকের এই ছবি ২৮ মার্চ তোলা। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও নাগরিকদের শ্রীলঙ্কা সফর নিয়ে সতর্ক করেছে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন নাগরিকদের প্রতি ‘ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা নিরুপনের পাশাপাশি সব আক্রান্ত এলাকা’ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন।

জাপানের সবচেয়ে বড় ট্রাভেল এজেন্সি জেটিবি বুকিং বাতিলের ফি ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি আগামী ১০ মে পর্যন্ত কলম্বোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বাদ দিয়ে সব ভ্রমণ প্যাকেজ পুনর্বিন্যাস করেছে।

প্রতিবেশী ভারতের দুই প্রধান এয়ারলাইন্স রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ার ইন্ডিয়া ও সবচেয়ে বড় বিমান কোম্পানি ইন্ডিগো বলেছে, ২৪ এপ্রিলের আগে বুকিং দেওয়া সব টিকেটের ক্ষেত্রে তা বাতিল বা ‘রিশিডিউল’ করার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফি ছাড় দেবে তারা।

কলম্বোর গল ফেস সৈকতের কাছে শাংরি-লা হোটেল। রোববারের বোমা হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে পাঁচ তারকা এই হোটেলটি। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

গত বছরের শ্রীলঙ্কা ভ্রমণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে ছিল ভারতীয়রা। সোয়া চার লাখ ভারতীয়র পরেই ছিল চীনাদের অবস্থান দুই লাখ ৬৬ হাজার। তৃতীয় অবস্থানে ছিল ব্রিটেনের নাগরিক, আড়াই লাখের বেশি ব্রিটিশ দেশটি সফর করেন।

শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন ডিসেম্বর থেকে মার্চে। মে থেকে সেপ্টেম্বর নাগাদ বর্ষা মওসুমে পর্যটকদের চাপ তুলনামূলক কম। 

ভারতের সবচেয়ে বড় ট্রাভেল বুকিং পোর্টালগুলোর একটি মেক মাই ট্রিপ ডটকম এক বিবৃতিতে বলছে, শ্রীলঙ্কার পর্যটনে হামলার কতটা প্রভাব পড়বে তা নির্ধারণ করা এখনই সম্ভব নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে অনেকেই দেশটি ভ্রমণ বাতিল করবেন বা অন্য কোথাও যাবেন।