বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত, তবুও আশার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ‘অলৌকিকতার গির্জা’

বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কার যে গির্জা হয়ে উঠেছিল সব ধর্মমতের মানুষের মিলনকেন্দ্র, ইস্টারের পরবে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর সেইন্ট অ্যান্থনির সেই ‘চার্চ অব মিরাকলসের’ দরজাগুলো বন্ধ হয়ে আছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2019, 11:56 AM
Updated : 23 April 2019, 11:56 AM

গির্জাটির ১৭৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম মানুষজনকে প্রবেশদ্বারগুলো থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

রোববার সকালের ওই বিস্ফোরণ ‘অলৌকিকতার গির্জাটিকে’ কিছু সময়ের জন্য স্তম্ভিত করে দিলেও ঠিকই এটি আশার প্রতীক হয়েই ফিরে আসবে, প্রত্যাশা লঙ্কানদের। 

বিবিসি বলছে, কচ্চিকাডের যে রাস্তাটি ধরে সেইন্ট অ্যান্থনির নামে হওয়া এ উপসনালয়ে যাওয়া যায়, তা কলম্বোর প্রায় সবার কাছেই অতি পরিচিত। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ এই রাস্তা ধরেই ঈশ্বরের কৃপা লাভের আশায় পৌঁছে যেতেন ‘চার্চ অব মিরাকলসে’।

পুরোপুরি একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ হওয়া সত্ত্বেও এর যাজকরা অন্য ধর্মে বিশ্বাসী অনেকের কাছেও ‘অলৌকিকতার কারিগর’ হিসেবে খ্যাত। অনুগামীরা বলেন- এমন কোনো প্রার্থনা নেই, হোক সে অনেক বিশাল, ক্ষুদ্র কিংবা অদ্ভুত, সেইন্ট অ্যান্থনি কাউকে ফেরান না।

যদিও সোমবার এ গির্জার চিত্র ছিল একেবারেই অচেনা। আগের দিনের বোমার বিস্ফোরণে সংকুচিত হয়ে পড়া গির্জার প্রবেশপথ আর সেইন্ট অ্যান্থনির বিশাল মূর্তির নিচে-চারপাশ পুণ্যার্থীর বদলে দখলে চলে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

প্রবেশপথে ছড়ানো ছিটানো ধ্বংসস্তূপ আর ভাঙা কাঁচের মধ্যেও চোখ চলে যাবে গির্জাটির বামপাশের টাওয়ারে স্থির হয়ে পড়া ঘড়ির দিকে; সেখানে তখনো বাজছে সকাল ৮টা ৪৫।

রোববার এ সময়েই কলম্বো এবং আশপাশের এলাকায় গির্জা-হোটেলসহ ছয়টি স্থানে আলাদা আলাদা বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। পরে ঘটে আরও দুটি বোমার বিস্ফোরণ।

এক দশক আগে বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগাররা উৎখাত হওয়ার পর এমন ভয়াবহ হামলা আর দেখেনি শ্রীলঙ্কা। এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩২১; আহতদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সোমবার মধ্যরাত থেকে জরুরি অবস্থাও জারি হয়েছে ভারত লাগোয়া দ্বীপরাষ্ট্রটিতে।

স্থানীয়রা বলছেন, সাধারণ দিনগুলোতেই সেইন্ট অ্যান্থনির গির্জা থাকে লোকে লোকারণ্য, আর রোববার ছিল ইস্টার সানডে। এদিনের প্রার্থনাসভায় হাজারের বেশি মানুষ উপস্থিত ছিলেন বলে ধারণা প্রধান যাজকের।

বিস্ফোরণে অসংখ্য হতাহতের কথা বলা হলেও কেবল এ ‘অলৌকিকতার গির্জা’তেই কতজনের প্রাণ গেছে তার চূড়ান্ত হিসাব মেলেনি।

পুলিশ সদস্যরা ‘নিরাপত্তা ঘেরাটোপের’ ভেতর কাউকে ঢুকতে না দিলেও সোমবার সকালেও গির্জার কয়েকশ গজ দূরে অনেককেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদের কেউ কেউ শূণ্য চোখে তাকিয়ে ছিলেন ক্ষতবিক্ষত সাদা ভবনটির দিকে।

“আমার বাড়ি এখানেই। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে দৌড়ে চলে আসি। যে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আশপাশের মানুষ সেসময় ভয়ডরহীন ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন,” বলেন সোমবার ‘চার্চ অব মিরাকলসের’ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাবাথ বুদ্ধিকা।

বৌদ্ধ ধর্মের এ অনুসারী এর আগেও বহুবার পরিবার পরিজন নিয়ে গির্জাটিতে এসেছেন, অন্য অনেকের মতো তিনিও নিজেকে ‘সেইন্ট অ্যান্থনির শক্তিতে’ বিশ্বাসী হিসেবেই দাবি করেন।

রোববার সকালের বিস্ফোরণের তোড়ে বিছানা কেঁপে ওঠায় ঘুম ভেঙে যায় গির্জার কাছেই বসবাস করা পিটার মাইকেল ফার্নান্ডোর। আকাশের দিকে উঠতে থাকা ধোঁয়া দেখে দ্রুত ছুটে আসেন গির্জাপ্রাঙ্গণে।

“অসংখ্য দেহ, দেহের অংশবিশেষ চারদিকে ছড়ানো ছিটানো। দুজনকে জীবিত পেয়ে তাদেরকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে সহায়তা করি। আমি তখন কাঁদছিলাম।” 

ঘটনার একদিন পরও তার চোখে ভাসছে হতাহত শিশুদের ছবি।

“তারা আতঙ্কে চিৎকার করছিল, রক্ত ঝরছিল তাদের। যতজনকে সাহায্য করা যায় তার চেষ্টা করছিলাম আমরা। এক শিশুকে তুলে নিয়ে ভ্যানে তুলে দিই, বোমায় তার পা উড়ে যায়,” বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন এ ক্যাথলিক।

খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরেই গির্জার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলেন নার্স আনুজা সুবাসিংহে। রোববার সকালে হাসপাতালে রিপোর্ট করার দায়িত্ব ছিল তার, যে কারণে বিস্ফোরণের সময় ছিলেন না এখানে।

“অসহনীয় দুঃখ বহন করছেন যারা, এ গির্জা ছিল তাদের জন্য। এ গির্জা তাদেরকে প্রবোধ দিত। কারা এরকম কিছু করতে পারে? কেন তারা এরকম করলো? 

বুদ্ধিকার মতো সুবাসিংহেও জন্মসূত্রে বৌদ্ধ ছিলেন, সেইন্ট অ্যান্থনির গির্জার সংস্পর্শে এসে পালটে ফেলেন ধর্ম।

কি আছে এ চার্চে যা মানুষকে এমন মন্ত্রমুগ্ধ করে? কাছাকাছি এক গির্জার যাজক লিও পেরেরা বলছেন, এর অলৌকিকতার কাহিনীগুলোই মানুষের কাছে একে আরও আকৃষ্ট করে তুলেছে।

যাজকদের লিখিত ইতিহাস মতে, গির্জাটির সূচনাও হয়েছিল অলৌকিকতার হাত ধরেই।

শ্রীলঙ্কায় আঠারো শতকের ডাচ শাসনামলে কলম্বোতে বসবাস করা অ্যান্টোনিও নামে গোপনে খ্রিস্টধর্মের চর্চা করা এক ব্যক্তিই আজকের এ ‘চার্চ অব মিরাকলস’ প্রতিষ্ঠা করেন।

অ্যান্টোনিওর পৈত্রিক নিবাস ছিল দক্ষিণ ভারতের কোচিনে।

কথিত আছে, একদিন সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে দেখে ভীত স্থানীয়রা অ্যান্টোনিওর দ্বারস্থ হয় এবং তাকে প্রার্থনার মাধ্যমে ওই পানি কমিয়ে দিতে অনুরোধ করে।

অ্যান্টোনিওর প্রার্থনা কেবল সমুদ্রের উত্থিত পানিকে নামিয়েই আনেনি, পানির স্তর এতটাই কমিয়ে দেয় যে নিচে থাকা বালুও উঁকি দিয়েছিল। সেখানেই পরে একটি ক্রুশ বসিয়ে কাদামাটির গির্জা বানান ফাদার অ্যান্টোনিও, যা এখন ‘অলৌকিকতার গির্জা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

লিও বলছেন, অনেক ভক্ত পুণ্যার্থীই এখানে এসে প্রার্থনার জবাব পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, গির্জা তাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে।

“যারাই সেখানে যায়, ফিরে আসে চমৎকার অনুভূতি নিয়ে। কেউ একজন তাদের প্রার্থনা শুনেছে বলেও মনে হয় তাদের।”

রোববারের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় কি ওই অনুভূতিগুলো মিলিয়ে যাবে?

“একেবারেই না। এ ধরনের ঘটনার পরও আপনি তাদের দূরে রাখতে পারবেন না। তারা আসতেই থাকবে, কারণ এখনই সময়, যখন তারা তাদের জীবনে ঈশ্বরের উপস্থিতি দেখতে চাইবে। কোনোভাবেই এ ঘটনা গির্জার ক্ষমতা কিংবা এর ওপর বিশ্বাসীদের আস্থা কমাতে পারবে না,” উত্তর এ যাজকের।

একই মত বুদ্ধিকারও।

“তারা (সন্ত্রাসী) জানে না তারা কি করেছে? এমন ঘটনা ঘটিয়ে পার পাবে না তারা,” ভাষ্য তার।

বিবিসি বলছে, কেবল প্রার্থনার শক্তিতেই সেইন্ট অ্যান্থনির এ গির্জা বলীয়ান নয়। এর আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে বহুত্ববাদ ও সহিষ্ণুতায়।

দশকের পর দশক ধরে চলা ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সম্প্রদায় তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ ঐতিহ্য নিয়েই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে একে অন্যের বিশ্বাস ও পার্থক্যে পাশে থেকেছে, সাহস যুগিয়েছে।

সন্ত্রাসবাদের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পরও তাই বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষ এক হয়ে গির্জার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে; ভাগ করে নিয়েছে শোক আর আতঙ্ককে।

অন্ধকার এ সময়েও তাই ‘অলৌকিকতার গির্জাই’ আশার প্রতীক হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে; নিজেদের দ্বিধাবিভক্তিকে দূরে সরিয়ে বিভিন্ন মতপথের লঙ্কানদের এক করছে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে।