ভোটের ডামাডোলে যাত্রার কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘মমতা’

ভোটের মওসুমে নয়া মাত্রা জুড়ছে মঞ্চ৷ চলছে রাজনৈতিক যাত্রাপালা৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনভিত্তিক পালা তৈরি করেছে একাধিক যাত্রা দল৷ একে কেউ বলছেন কৃতজ্ঞতার প্রতিদান, কেউ বলছেন চাটুকারিতা৷

ডয়চে ভেলে বাংলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 April 2019, 05:50 PM
Updated : 18 April 2019, 05:51 PM

লোকসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে ভারতে৷ সেই প্রচারে সভা-সমিতি-মিছিল যেমন হচ্ছে, তেমনই চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার৷ এই প্রচারে অন্য মাত্রা জুড়েছে যাত্রাপালা৷ বিনোদনের নানা উপকরণ চলে আসায় যাত্রার মতো প্রাচীন শিল্প মাধ্যম এখন কোণঠাসা৷ এর মধ্যেই একাধিক যাত্রা তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনীর ওপর ভিত্তি করে৷ সেই অর্থে এটা রাজনৈতিক দলের প্রচার নয়৷ যাত্রা দলের বিষয় চয়নেই একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কার্যত প্রচার হয়ে উঠেছে৷

একাধিক পালা তৈরি হয়েছে, যার নামকরণেই রয়েছে মমতার উল্লেখ৷ যেমন, ‘মমতার ডাকে দিল্লি চলো', ‘বাংলার ক্ষমতায় এবার মমতা', ‘দিদি তোমার জবাব নেই'৷ কেন এ ধরনের বিষয় বেছে নেওয়া হচ্ছে, সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ডয়চে ভেলে হাজির হয়েছিল যাত্রাশিল্পের পাড়া কলকাতার চিৎপুরে৷ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত একাংশের বক্তব্য, যাত্রার শিল্পী ও কলা-কুশলীদের পাশে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল সরকার৷

লোকবন্দনা অপেরার ‘মমতার ডাকে দিল্লি চলো' পালায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সীতা ঘোষ৷ তিনি অতীতে ‘মা-মাটির লড়াই' এবং ‘বাংলার মসনদে মমতা' নামের দুটি পালাতেও মমতার ভূমিকায় ছিলেন৷

এই অভিনেত্রী বলেন, “আগে কোনো সরকার যাত্রার দিকে নজর দেয়নি৷ মমতা সরকার আমাদের গুরুত্ব দিয়েছে৷ শুধু ভাতার ব্যবস্থাই করেনি, শিল্পীদের স্বীকৃতি দিয়েছে৷ সে জন্য আমরা কৃতজ্ঞ৷ গোটা যাত্রা পাড়াই কৃতজ্ঞ৷”

মমতার নামে যাত্রা যে তারই ফলশ্রুতি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷

তবে সবটাই মুখ্যমন্ত্রীর অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, এমনটা মনে করছেন না যাত্রা দলের সংগঠকরা৷ কলকাতা যাত্রা কর্মী ইউনিয়নের সম্পাদক হারাধন রায় বলেন, “যাত্রা শিল্পের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর অবদান নিশ্চয়ই আছে৷ তবে শুধু সে কারণে নয়, জীবননির্ভর পালা এর আগেও হয়েছে৷ ১৯৯২ সালে ‘বাংলার বাঘিনী' মমতা বলে আমি একটি যাত্রার আয়োজক ছিলাম৷ সেটা তখনকার সরকার বাধা দিয়েছিল৷ তবে বর্ণময় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জীবনকেন্দ্রিক পালা নতুন কোনো প্রবণতা নয়৷ এর আগে ইন্দিরা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও যাত্রা হয়েছে৷

“মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতীত ঘটনাবহুল৷ অনেক সংগ্রামের পথ পেরিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন৷ পালা লেখার জন্য এ ধরনের কাহিনীর প্রয়োজন হয়৷ সে কারণে মুখ্যমন্ত্রীর সাদামাটা জীবনকে বেছে নিয়েছেন একাধিক পালানির্মাতা৷ সেই পালা জনপ্রিয়ও হয়েছে।”

নিছকই তোষামোদ?

মুখ্যমন্ত্রীর অবদানের ফলস্বরূপ তার নামে পালা তৈরি হচ্ছে, এমনটা সবাই মনে করেন না৷ একাংশের মতে, এর পিছনে তোষামোদও রয়েছে৷

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যাত্রাকর্মী বলেন, “বাম আমলের তুলনায় এখন যাত্রা শিল্প বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, এটা ঠিকই৷ বিপুল টাকা খরচ করে জানুয়ারিতে যাত্রা উৎসবও হচ্ছে৷ তবে এত মমতানির্ভর পালা সে কারণে হচ্ছে না৷ আদতে শাসক দলের নেকনজরে থাকতে কে না চায়? তাই পুরস্কার বা সম্মাননার কথা ভেবে এ ধরনের পালা তৈরির হিড়িক পড়ে গিয়েছে।”

আর এক যাত্রাকর্মী বলেন, “কংগ্রেস আমলে সরকারের সমালোচনা করে কোনো যাত্রা মঞ্চস্থ করলে সেটা বন্ধের চেষ্টা চালানো হত৷ পরে বাম আমলে সমালোচনামূলক পালা হলে সেটা পাল্টে ফেলতে বাধ্য করা হত৷ আর তৃণমূলের রাজত্বে সবটাই পক্ষে৷ সমালোচনা করা হচ্ছে না।”

তবে রাজনীতিকদের সমালোচনা হচ্ছে না, তা নয়৷ মমতার জীবননির্ভর একাধিক যাত্রাপালার প্রযোজক কনক ভট্টাচার্য বলেন, “শাসক দলের অত্যাচারের মুখে যারা পড়েছেন, তাদের কথাও দেখানো হচ্ছে৷ ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ' পালায় তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে রাজনীতিক ও গুন্ডারা প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করছে৷ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে, এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে৷”

একইভাবে বিমুদ্রাকরণের ফলে দেশের মানুষের যে সমস্যা হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে ‘ভালো মানুষের ভাত নেই'৷ রূপশ্রী, কন্যাশ্রী নিয়ে মমতার সাফল্য তুলে ধরেছে ‘দিদি তোমার জবাব নেই' পালা৷

জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে নেই

মমতার জীবননির্ভর পালা যে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সে কথা বলছেন মমতার ভূমিকায় থাকা অভিনেত্রীরাই। শুধু গ্রামবাংলা নয়, খোদ শহরের বুকেও রমরমিয়ে এসব পালা চলেছে৷ ‘বাংলার ক্ষমতায় এবার মমতা' পালার মমতারূপী রুমা চক্রবর্তী বলেন, “মানুষ পালা দেখে আমাকেই মুখ্যমন্ত্রী বলে মনে করেছিল৷ যাত্রা মঞ্চস্থ হওয়ার পর আমাকে গ্রামের মানুষেরা তাদের অভাব-অভিযোগ জানাতে ছুটে এসেছিলেন৷ কোথাও রাস্তা হয়নি, কোথাও চাষের জল দরকার, এসব অভিযোগ নিয়ে তারা আমাকে অভিযোগ জানাতে ব্যগ্র ছিলেন।”

সীতা ঘোষও বলেন, “দিদির বলা কথাগুলো চরিত্রের মধ্যে দেওয়া আছে৷ সেগুলোই বলেছি৷ দর্শকদের বাহবা পেয়েছি৷ জঙ্গলমহল, অনশন মঞ্চ, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, ব্রিগেডের জোট সবটাই দেখানো হয়েছে৷ এরই মধ্যে ৪০টা শো হয়েছে৷ বিভিন্ন জায়গায় নেতাদের বা পার্টি অফিসের ডাকে এই পালা দেখানো হয়েছে৷ অনুব্রত মণ্ডল, মদন মিত্র, অরূপ বিশ্বাস সকলেই যাত্রা দেখেছেন, বাহবা দিয়েছেন৷ দিদি নিজে আমায় জন্মদিনে চিঠি দিয়েছে।” 

এ বছর নির্বাচন হচ্ছে বলে নয়, আগেও মমতার জীবননির্ভর যাত্রা হয়েছে৷ কিন্তু ভোট মওসুমে এই যাত্রাকে প্রচার হিসেবেই দেখছে বিরোধীরা৷ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, “মা-মাটি-মানুষের যাত্রা সারা বছরই চলছে৷ দলের নেতা-নেত্রীরা নানাভাবে যাত্রা করে চলেছেন৷ কাজেই মঞ্চের যাত্রায় নতুন কী আর পাওয়া যাবে?”

বিরোধীদের দাবি, এটা নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল৷ তাই ব্যবস্থা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন৷ গত মঙ্গলবার ‘মমতার ডাকে দিল্লী চলো'-র একটা শো ছিল৷ কিন্তু সেটা বাতিল করা হয়েছে৷ আয়োজকদের তরফে বলা হয়েছে, পালা মঞ্চস্থ করার অনুমতি পাওয়া যায়নি৷ কমিশন সায় দেয়নি৷