পশ্চিমবঙ্গে তুলকালাম, রাতভর ধর্নায় মমতা

ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা সারদা দুর্নীতি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বাসায় হাজির হওয়ার পর তুলকালাম বাঁধিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2019, 05:24 AM
Updated : 8 Feb 2019, 04:58 PM

এর প্রতিবাদে কলকাতার ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে অবস্থান নিয়ে সেখানেই রাত কাটিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার সকালে ভারতীয় সংবাদপত্রগুলোর সবচেয়ে বড় খবর এটাই। 

পশ্চিমবঙ্গের বাংলায় এ ধরনের অবস্থান কর্মসূচিকে বলে ধর্না। আর মমতা তার এই প্রতিবাদকে মহাত্মা গান্ধীর ভাষায় বলতে চাইছেন ‘সত্যাগ্রহ’।

তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্র সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে দেশের সব গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলছে। এ কারণে গণতন্ত্র রক্ষা করতে এবং দেশকে বাঁচাতেই তিনি ধর্নায় বসেছেন।

এনডিটিভির প্রতিবেদন বলছে, রোববার সন্ধ্যায় সিবিআই এবং রাজ্য পুলিশের বিরোধ যে নজিরবিহীন চেহারা নিয়ে প্রকাশ্য হয়েছিল, রাতভর ধর্নায় বসে মমতা তাকে কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে রাজ্যের সংঘাতের মাত্রায় নিয়ে গেছেন। 

বছর ছয়েক আগে সারদা ও রোজভ্যালি কেলেঙ্কারিতে এমএলএম ব্যবসার ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি রুপি হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে মমতার তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের আঙুল ওঠে।

বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, ওই কেলেঙ্কারির তদন্তের জন্যে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তে যেসব তথ্যপ্রমাণ তিনি জব্দ করেছিলেন সেগুলো তিনি সিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করেননি বলে পরে অভিযোগ ওঠে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা বিজেপি নেতাদের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাসহ তৃণমূল নেতাদের বাঁচাতেই তথ্যপ্রমাণ গায়েব করেছেন রাজীব কুমার।

ইনডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য কয়েক দফা নোটিস দিয়েও রাজিবের সাড়া পায়নি সিবিআই। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে গুঞ্জন চলছিল কয়েক দিন ধরে। 

এই পরিস্থিতিতে রোববার সন্ধ্যায় কলকাতার লাউডন স্ট্রিটে পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে হাজির হন সিবিআই কর্মকর্তা। আর তাতেই নাটকীয়তার সূচনা। 

বিবিসি বাংলা লিখেছে, প্রথমে সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সিবিআই কর্মকর্তাদের বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেয়। পরে দুপক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়।

এক পর্যায়ে সিবিআই কর্মকর্তাদের টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে শেক্সপিয়ার সরণি থানায় নিয়ে যায় কলকাতার পুলিশ। ‘নজিরবিহীন’ এ ঘটনায় পুরো শহরে শোরগোল পড়ে যায়। অবশ্য পরে সিবিআই কর্মকর্তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

আনন্দবাজার লিখেছে, নাটকীয়তাকে নতুন মাত্রা দিয়ে এর পরপরই পুলিশ কমিশনারের বাসায় হাজির হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেখানে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্র এবং এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মাকে নিয়ে তিনি বৈঠকে বসেন।

ওই বৈঠক শেষে বেরিয়ে মমতা সাংবাদিকদের সামনে এসে বলেন, “নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ- বিজেপির দুই গুণ্ডা মিলে বাংলায় ‘ক্যু’ করার চেষ্টা করছেন। যে ত্রাস শুরু হয়েছে তা জরুরি অবস্থার থেকেও ভয়াবহ। ক্ষমতায় ফিরবেন না বুঝে মোদী পাগল হয়ে গিয়েছেন। এবার কি রাজ্যে ৩৫৫ ধারা জারি হবে, না কি ৩৫৬?”

মমত ঘোষণা দেন, মোদী সরকারের হাত থেকে ভারতের ‘সংবিধানকে বাঁচাতে’ তিনি ধর্নায় বসবেন। রাতেই ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে শুরু হয় তার সেই প্রতিবাদী অবস্থান।

এবেলার প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রথমে রাস্তার উপরে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। পরে পাশে মঞ্চ তৈরি হয়। মঞ্চের পাশেই তৈরি হয় একটি অস্থায়ী ছাউনি, সেটা মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য।

মমতা জানিয়ে দেন, সোমবার বিধানসভার বাজেট ঘোষণার সময় তিনি অধিবেশনে উপস্থিত থাকবেন না। বাজেট পেশের আগে মন্ত্রিসভার যে বৈঠক করতে হয় তা তিনি মঞ্চের পাশে ওই ছাউনিতে বসেই সারবেন।

মমতার ধর্নায় ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে রাতে নেতাকর্মীদের ভিড় লেগে যায়। তৃণমূলের নেতা ও মন্ত্রীদের পাশাপাশি পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকেও দেখা যায় সেখানে।

তাকে পাশে নিয়ে মমতা বলেন, “কলকাতা পুলিশের বর্তমান কমিশনার বিশ্বের সেরাদের মধ্যে একজন। তার সততা ও সাহসিকতা প্রশংসাতীত। উনি ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যান। মাত্র একদিনের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন। তাতেও এত প্রশ্ন! মিথ্যে ছড়ানোর একটা লিমিট থাকে!”

এদিকে ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতারা রাতেই মমতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। রাহুল গান্ধী, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, অখিলেশ যাদব ও ওমর আবদুল্লা ফোন করেছেন বলে মমতা ধর্নায় বসে জানান। কেউ কেউ টুইট করেও মামতার পাশে থাকার কথা বলেন।

 

অন্যদিকে বিজেপির সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় টুইট করে পশ্চিমবঙ্গে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির দাবি তোলেন।

সেখানে তিনি বলেন, “দুর্নীতিগ্রস্থ মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যটাকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছেন। এখন সিবিআই-এর কোপ পড়ায় নিজের দুর্নীতির সঙ্গীদের বাঁচাতে উঠে পড়ে লেগেছেন।”

পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকার সময়ও রাজপথে এরকম প্রতিবাদী আন্দোলনে বহুবার দেখা গেছে মমতাকে। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে ওই মেট্রো চ্যানেলেই ২৬ দিন অনশন করেছিলেন তিনি।

সে প্রসঙ্গ টেনে আনন্দবাজার লিখেছে, “লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে বিরোধী দলগুলো যখন সম্মিলিতভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে জোট বাঁধার চেষ্টা করছে এবং কলকাতার ব্রিগেড সমাবেশে শপথ গ্রহণ করেছে, তখন তাৎপর্যপূর্ণভাবে মমতার ধর্না দেশের বিরোধী রাজনীতিতেও নতুন মাত্রা যোগ করল বলে রাজনৈতিক মহলে অনেকের অভিমত।”