রাখাইন অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল গণহত্যা: জাতিসংঘের প্রতিবেদন

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ থেকেই রাখাইনের অভিযানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটিয়েছে মনে করছে জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন।    

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2018, 08:18 AM
Updated : 31 August 2018, 03:04 AM

আইন প্রয়োগের নামে ভয়ঙ্কর ওই অপরাধ সংঘটনের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এবং জ্যেষ্ঠ পাঁচ জেনারেলকে বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করা হয়েছে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে।   

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার ওই প্রতিবেদনে রাখাইনের পাশাপাশি শান ও কাচিন অঞ্চলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চির বেসামরিক সরকার ‘বিদ্বেষমূলক প্রচারকে উসকে’ দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ ‘আলামত ধ্বংস’ করেছে এবং সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে ‘ব্যর্থ হয়েছে’। আর এর মধ্যে দিয়ে মিয়ানমার সরকারও নৃশংসতায় ‘ভূমিকা’ রেখেছে।        

২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল। তাদের কথায় পাওয়া যায় নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ।

মিয়ানমারের সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের ওই লড়াই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নয়।

জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে বলে হয়, যে পরিমাণ নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা সেখানে বলা হচ্ছে, তার তুলনায় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার পার্থক্যটা খুবই স্পষ্ট। 

রয়টার্স লিখেছে, কোনো নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম বা বর্ণের গোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হলে তাকে জাতিসংঘ গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করে।   

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলছে, রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য। 

তাদের ২০ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ‘যথাযোগ্য’ আদালতে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার মত যথেষ্ট তথ্য ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পেয়েছে।

রয়টার্স জানিয়েছে, জাতিসংঘের কাজের পদ্ধতি অনুযায়ী ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগে এর একটি অনুলিপি মিয়ানমার সরকারকে দিয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য তারা করেনি।  

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল তুন তুন নাইকে ফোন করা হলেও তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়।

ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মারজুকি দারুসমানের নেতৃত্বে গঠিত এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের পাশাপাশি পাঁচজন জেনারেলের নাম উল্লেখ করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে বলা হয়েছে।

এর মধ্যে মিয়ানমারের ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং অংয়ের নামও রয়েছে, যার বাহিনী উপকূলীয় ইন দিন এলাকায় অভিযানের দায়িত্বে রয়েছে। ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়ার ঘটনাটি ওই এলাকাতেই ঘটেছিল।    

রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ইন দিনের ওই ঘটনা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার পর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দশ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। সাতজন সৈনিককে ওই অপরাধের যুক্ত থাকার দায়ে দশ বছর করে সাজাও দেওয়া হয়েছিল।

রয়টার্সের ওই দুই সাংবাদিককেও এখন রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি রাখাইনের ঘটনাপ্রবাহ বন্ধে সরকারপ্রধান হিসেবে তার কর্তৃত্ব বা নৈতিক বিবেচনা- কোনোটিই কাজে লাগাননি; নাগরিকদের রক্ষার যে দায়িত্ব তার ওপর রয়েছে, তা পালনের জন্য বিকল্প কোনো পথও তিনি খুঁজে বের করেননি।    

রয়টার্স বলেছে, এ বিষয়ে সু চির মুখপাত্র জ তাইয়ের কোনো বক্তব্য তারা জানতে পারেনি।

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তদন্তকারীরা তাদের প্রতিবেদনে বলেছেন, রাখাইনের হত্যাযজ্ঞের হোতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা অস্থায়ী একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্যে দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে; আর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকেই এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। 

এর পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিষদে ওই হোতাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা বা এ ধরনের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

যে ছয় জেনারেলের বিচারের সুপারিশ প্রতিবেদনে করা হয়েছে তাদের মধে বাকি চারজন হলেন-  সেনাবাহিনীর উপ প্রধান ভাইস সিনিয়র জেনারেল সো উইন, ব্যুরো অব স্পেশাল অপারেশনস-৩ এর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অং কিয়াও জ, পশ্চিমাঞ্চলীয় মিলিটারি কমান্ডের প্রধান মেজর জেনারেল মং মং সো এবং ৯৯তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থান ও। 

রয়টার্স লিখেছে, গতবছর গঠিত জাতিসংঘের এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্যরা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা ৮৭৫ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়ে, নথিপত্র, ভিডিও, ছবি এবং স্যাটেলাইট ইমেজ পর্যালোচনা করে ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।  

সেখানে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্র আরোপিত যে অবিচার চলছে তা প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়নের রূপ পাওয়ায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ভুগতে হচ্ছে এই জনগোষ্ঠীকে। 

রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও  ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে। দেশটির স্টেট কাউন্সিলর শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চিও কখনও রোহিঙ্গা শব্দটি মুখে আনেন না।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের অপরাধের জন্য পূর্ণ দায়মুক্তি পেয়ে আসছে, কখনোই তাদের বিচারের জবাবদিহি করতে হয়নি। কোনো একটি অভিযোগ উঠলেই তা অস্বীকার করা, খারিজ করে দেওয়া এবং তদন্তের পথ বন্ধ করে দেওয়া হল তাদের সাধারণ নিয়ম।     

রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে আট লাখ মানুষকে হত্যার ঘটনায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কর্নেল থিওনেস্টে বাগোসোরাকে ২০০৮ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় জাতিসংঘ গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। পরে আপিলে তার সাজা কমিয়ে ৩৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

১৯৯৫ সালে বসনিয়ার সেব্রেনিকা শহরে গণহত্যার জন্য হেগের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল সার্ব নেতা রদোভান কারাদিচকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেয়।