ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা ফের নির্যাতিত: এইচআরডব্লিউ

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের অনেকেই দেশে ফেরার পর ফের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। 

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2018, 02:23 PM
Updated : 23 August 2018, 02:51 PM

মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, “দেশে ফেরা শরণার্থীদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি মিয়ানমার সরকার দিয়েছিল, প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের নির্যাতন সেই প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যায় পর্যবসিত করেছে।”

এজন্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আগে বিষয়টিতে জাতিসংঘের নজরদারিসহ আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সুরক্ষা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি।  

মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ হবে বলে নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও ফিরে যাওয়া নাগরিকরা এখনো হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে বিবৃতিতে বলেছেন রবার্টসন।  

“যারা বিশ্বাস করেন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিরাপদ প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে এই আচরণ তাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হতে পারে। স্বেচ্ছায়, নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি প্রতিষ্ঠার আগে মিয়ানমারকে আরও বহুদূর পথ পাড়ি দিতে হবে।”

রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে গত অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে।  বড় আকারে না হলেও এখনো রোহিঙ্গাদের আসা বন্ধ হয়নি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে এশিয়ার এ অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। তবে মিয়ানমার সরকার তা অস্বীকার করে বলে আসছে, ওই অভিযান চালানো হয়েছে ‘সন্ত্রাসীদের বিরদ্ধে’।

বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গত বছরের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সম্মতিপত্রে সই করে। এর ভিত্তিতে দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয় এবং ১৬ জানুয়ারি ওই গ্রুপের প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।

এরপর প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারকে আট হাজারের মতো রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হলেও কেউ এখনও রাখাইনে ফিরতে পারেনি।

তবে সীমান্তের শূন্য রেখায় আশ্রয় নেওয়া কিছু রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরেছেন বলে খবর এসেছে গণমাধ্যমে।

এইচআরডব্লিউর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘জাতিগত নিধনের’ মুখে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া ছয় রোহিঙ্গা নাগরিক সম্প্রতি রাখাইনে ফেরার পর কয়েকদফা দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) হাতে আটক হন। এসব রোহিঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল কিছু অর্থ জোগাড়ের পর আবার বাংলাদেশে ফিরবে তারা।    

নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর তাদেরকে নির্যাতন করা হয় এবং পরবর্তীতে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের অপরাধে প্রত্যেককে চার বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এক মাস কারাভোগের পর ওই ছয় জনসহ আরও কয়েক ডজন রোহিঙ্গাকে ক্ষমা করে দেয় সরকার। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তাদের প্রত্যাবাসন নিরাপদ, তা প্রমাণের জন্য মুক্তি পাওয়া এসব নাগরিকদের মিয়ানমার সফররত সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। ওই ঘটনার পর ছয় জন রোহিঙ্গা ফের বাংলাদেশে পাড়ি জমান।

দেশে ফিরে নির্যাতনের শিকার ওই ছয় রোহিঙ্গা পুরুষ এবং কিশোর এইচআরডব্লিউকে জানিয়েছেন, বিজিপির কর্মকর্তারা বারবার বন্দুকের মুখে জঙ্গিগোষ্ঠি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা’র বিষয়ে জানতে চেয়েছে। তাদেরকে মংডুর বিভিন্ন কাস্টডিতে বিভিন্ন সময়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলেও জানান তারা।    

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা, পালংখালি সীমান্ত।(ফাইল ছবি)। রয়টার্স

নির্যাতিত রোহিঙ্গারা জানান, আরসার সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করতে বিজিপি কর্মকর্তারা তাদেরকে কিলঘুসি ছাড়া লাঠি ও রড দিয়ে পেটায়; আগুন দিয়ে ঝলসে দেওয়া বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

আটকাবস্থায় বিশুদ্ধ, পয়ঃনিষ্কাশন, পর্যাপ্ত খাবার, কোনো আইনি সহায়তা এবং বার্মিজ দোভাষীর সহায়তাও তাদের দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন তারা।

বিজিপির নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ১৭ বছর বয়সী কিশোর রহমত (ছদ্মনাম) বলেন, “তারা প্লাস্টিকের ব্যাগ আগুনে গলিয়ে ফোটা ফোটা করে সেই তরল আমার শরীরে ফেলা হয়েছে। লোহার রড গরম করে দুই পায়ে ছ্যাঁকাও দিয়েছে, কখনো কখনো জলন্ত সিগারেট শরীরে চেপে ধরেছে, জ্বলন্ত মোম শরীরে ঢেলেছে, ব্লেড দিয়ে শরীরে আঁচড় কেটেছে, লাঠি আর রড দিয়ে পিটিয়েছে।”

রহমতের সমবয়সী আহমেদ (ছদ্মনাম) জানান, তাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে পোটানো হত। তিনি আরসার সদস্য- বিজিপি কর্মকর্তারা তার মুখ থেকে সেই কথা বের করতে চেয়েছিল বলে জানান আহমেদ।

নির্যাতিত ২৪ বছরের যুবক লোকমানও (ছদ্মনাম) বিজিপির নির্মমতার বর্ণনা দিয়েছেন।

“আমি আরসার সদস্য- এই স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টায় প্রথমেই তারা আমার বুকে এবং ‍উরুতে লাথি মারে এবং পরে বৈদ্যুতিক শক দেয়। কিন্তু তারা আমার কাছ মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেনি।

সাক্ষাৎকারের সময় তাদের শরীরে নির্যাতন এবং পোড়াক্ষত দেখা গেছে বলে এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে।

এই তিন রোহিঙ্গা নাগরিক জানিয়েছেন, তাদের প্রত্যেককেই চারদিন করে বিজিপির বন্দিশালায় কাটাতে হয়েছে, যেখানে দিনে দুইবার তাদের মাছের তৈরি লেই (এনগাপি) এবং ২৫০ মিলিলিটার নোংরা পানি খেতে দেওয়া হত।

আদালত চার বছর করে কারাদণ্ডের রায় দেওয়ার পর কয়েকশ আসামির সঙ্গে তাদেরকে মংডুর বুথিডং কারগারে নেওয়া হয়। আসামির মধ্যে অধিকাংশই ছিল রোহিঙ্গা।

গত ২৩ মে মংডুর জেলা প্রশাসক জানান, প্রেসিডেন্ট ইউন মিন্ট কয়েক ডজন রোহিঙ্গাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে জাতীয় পরিচয়পত্র (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড-এনভিসি) দেওয়া হবে। 

তবে এনভিসিতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না বলে অনেকেই তা নিতে অস্বীকৃতি জানান।

বিজিপি কর্মকর্তারা এমন ৬২ জন রোহিঙ্গাকে এনগা খু ইয়া গ্রামে একটি কার্যালয়ে নিয়ে তাদেরকে এনভিসি নিতে চাপপ্রয়োগের পাশাপাশি ফের গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়েছিলেন বলে এইচআরডব্লিউর বিবৃতিতে বলা হয়।

এরপর রোহিঙ্গাদের এই দলটিকে হ্লা পোয়ে কুয়াং ট্রানজিট ক্যাম্পে নেওয়া হয়, সেখানে ১ জুন তাদেরকে গণমাধ্যমের মুখোমুখি করা হয়। সংবাদকর্মীদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার আয়োজনটি করেছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা।

সেখানে মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী উই মিয়াট আই রোহিঙ্গাদের বলেন, তাদেরকে বাড়িঘর পুননির্মাণের জন্য অর্থ এবং মানবিক সহায়তা দেওয়া হবে। তারা বাংলাদেশ থেকে তাদের পরিবারকেও নিয়ে আসতে পারবে বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রী।

ওই ছয় শরণার্থী এইচআরডব্লিউকে জানান, গণমাধ্যমের সামনে কি বলতে হবে তা তাদের আগে থেকেই শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক কিশোর জানান, তিনি নির্দেশনা না মেনে কথা বলা শুরু করলে তাকে আর বলতে দেওয়া হয়নি।

সংবাদকর্মীরা চলে যাওয়ার পর তাদেরকে বলা হয়, তারা ট্রানজিট ক্যাম্প ত্যাগ করতে পারবে না। আবার গ্রেপ্তার করা হতে পারে, এই শঙ্কায় পরবর্তীতে সাক্ষাৎকার নেওয়া এইচআরডব্লিউ কর্মীরাসহ শরণার্থীদের দুটি পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।

এই ঘটনায় সরকারের মুখপাত্র স্টেট কাউন্সিল কার্যালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল জ তাইয়ের বক্তব্য জানতে কয়েকবার যোগাযোগ করেও তাকে পায়নি এইচআরডব্লিউ।