রাখাইনে প্রমাণ সংগ্রহে জাতিসংঘের তদারকির প্রস্তাব ব্রিটিশ দূতের

জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত কারেন পিয়ার্স বলেছেন, রাখাইনে সেনা অভিযানে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বরতার প্রমাণ সংগ্রহে মিয়ানমারকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদ ভাবতে পারে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2018, 08:47 AM
Updated : 2 May 2018, 08:47 AM

গতবছর ২৫ অগাস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওই অভিযানে গ্রামে গ্রামে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ এসেছে প্রাণে বেঁচে যাওয়ার রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে বর্ণনা করে আসছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে।

রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সরাসরি দেখতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে চার দিনের সফর শেষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা ফিরে যাওয়ার আগে বুধবার রয়টার্সের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন কারেন পিয়ার্স।

তিনি বলেন, “এখন নিরাপত্তা পরিষদে বসে আমাদের সবচেয়ে ভালো এবং বাস্তবায়নযোগ্য সমাধানটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, যাতে প্রমাণ সংগ্রহ করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বা কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনার কাছে তা হস্তান্তর করা যায়।” 

এর আগে ব্রিটিশ দূত সাংবাদিকদের বলেন, রাখাইনে তদন্ত করতে গেলে জবাবদিহিতার স্বার্থেই প্রামাণিক মান নিশ্চিত করতে হবে। দুইভাবে এটা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পরামর্শ অনুযায়ী ওই তদন্ত হতে পারে, অথবা মিয়ানমার সরকার নিজেরাই সেটা করতে পারে।    

রয়টার্স লিখেছে, কারেন পিয়ার্সের এই প্রস্তাব নিয়ে মিয়ানমারে জাতিসংঘ মিশনের কোনো বক্তব্য তারা জানতে পারেনি।

সোমবার নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি বলেছিলেন, রাখাইনে কোনো ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডের ‘বিশ্বাসযোগ্য’ অভিযোগ পেলে তার সরকার অবশ্যই তা তদন্ত করবে।

আর দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হলাইং জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের বলেছেন, রাখাইনে ধর্ষণের ঘটনায় কেউ জড়িত হলে সেনাবাহিনী অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেবে।

মিয়ানমার সরকার এবং দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। তাদের ভাষায় ওই অভিযান ছিল ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইসিদ্ধ ব্যবস্থা’।

রাখাইনে ওই দমন অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা গত রোববার কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখেন এবং তাদের মুখ থেকেই তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনেন। 

সোমবার বাংলাদেশ থেকে তারা মিয়ানমারের নেপিদোতে পৌঁছান এবং মঙ্গলবার মিলিটারি হেলিকপ্টারে থেকে রাখাইনের উত্তরাংশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।

রয়টার্স লিখেছে, জাতিসংঘের অপারেশনাল স্যাটেলাইট অ্যাপ্লিকেশনস প্রোগ্রাম- ইউএনওএসএটি থেকে পাওয়া রাখাইনের ছবিতে শত শত গ্রামের চিহ্ন পাওয়া যায়, যেগুলো পুড়িয়ে বা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরকম বহু গ্রাম ওই হেলিকপ্টার থেকেও দেখতে পাওয়ার কথা জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার যে অস্থায়ী ক্যাম্প ও রিসেপশন পয়েন্ট খুলেছে, সেখানেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের। ওই ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য প্রতিনিধি দলের সদস্যদের দুটো রোহিঙ্গা গ্রাম পার হতে হয়েছে, যেগুলো সম্প্রতি বুলডোজার দিয়ে মিশিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

নৃশসংশতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে এক অভ্যন্তরীণ তদন্তের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত নভেম্বরে এক প্রতিবেদনে দাবি করে, তাদের সৈন্যরা সেসব কিছুই করেনি।

তবে পরে এক গণকবরে ১০ জন রোহিঙ্গার মৃতদেহ পাওয়া গেলে মিয়ানমারের সাত সৈন্যকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় সামরিক আদালতে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের তদন্ত প্রতিবেদনের বিস্তারিত প্রকাশ না করায় জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসাইন গত মার্চে বলেছিলেন,  সেখানে গণহত্যা হয়েছে বলেই তার সন্দেহ। এর জবাবে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার অভিযোগের পক্ষে স্পষ্ট প্রমাণ দাবি করেছিল মিয়ানমার।

হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কৌঁসুলি ফাতোও বেনসুদা রোহিঙ্গা বিতারণ প্রশ্নে গতমাসে ওই আদালতে একটি আবেদন করেন। লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে যেভাবে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বিতাড়িত করা হয়েছে, তার বিচার করার এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আছে কি না- তা জানতে চাওয়া হয় সেখানে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিষয়টি বিচারের এখতিয়ার রাখে বলে রুল পাওয়া গেলে রোহিঙ্গা বিতাড়নের বিষয়ে তদন্ত করার পথ তৈরি হবে ফাতোও বেনসুদার সামনে।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এ আদালতের সদস্য হলেও মিয়ানামার তা নয়।  প্রসিকিউটর বেনসুদা মনে করছেন, দেশত্যাগে বাধ্য করা যে ধরনের আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, তার ধরণ বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারিক এখতিয়ারের পক্ষে রুল এলে, তাতেও বিষয়টি বিচারের জন্য একটি আইন কাঠামো দাঁড় করানো যাবে।