বর্মি সেনাদের ধর্ষণযজ্ঞের ভয়াবহ বিবরণ রোহিঙ্গা নারীদের মুখে

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে মিয়ানমারের সৈন্যরা হত্যা, লুটপাট, জ্বালাও পোড়াওয়ের পাশাপাশি ব্যাপক হারে যে যৌন সহিংসতা চালাচ্ছে, তার ভয়ঙ্কর বিবরণ উঠে এসেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে।    

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2017, 03:54 PM
Updated : 16 Nov 2017, 03:54 PM

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ৩৭ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে যে অভিযান চালাচ্ছে, তার গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ একটি অংশ এই ব্যাপক হারে ধর্ষণ।

‘অল অফ মাই বডি ওয়াজ পেইন: সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স এগেইনস্ট রোহিঙ্গা উইমেন অ্যান্ড গার্লস ইন বার্মা’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৫২ জন রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে, যাদের মধ্যে ২৯ জন ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর প্রাণ নিয়ে রাখাইন থেকে পালাতে পেরেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের শিকার এই নারী ও শিশুরা ছিল রাখাইনের ১৯টি গ্রামের বাসিন্দা। তাদের অনেকেই নিজের চোখের সামনে স্বামী, সন্তান বা বাবা-মাকে খুন হতে দেখেছেন। পাশবিক নির্যাতনের পর রক্তাক্ত দেহ নিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছেন বাংলাদেশে।

কেবল গ্রামে গ্রামে হামলার সময় নয়, হামলার আগে বা পরে দীর্ঘ হয়রানির মধ্যেও রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে রাখাইনে।  

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছে, যেসব ঘটনার বিবরণ তারা পেয়েছে, তার প্রতিটিতেই ধর্ষক ছিল মিয়ানমারের কোনো না কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। তাদের সঙ্গে রাখাইনের স্থানীয় মগরাও যৌন নিপীড়ন ও লুটপাটে অংশ নিয়েছে।

এইচআরডব্লিউর উইম্যান রাইটস ইমার্জেন্সিস বিভাগের গবেষক স্কাই হুইলার বলেন, অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী তাদের দেহ ও মনে বর্মি সেনাদের বর্বর সহিংসতার ক্ষত বহন করছে। 

গত ২৪ অগাস্ট রাতে রাখাইনে কয়েক ডজন পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেনাবাহিনীর এই অভিযান শুরু হয়, যাকে জাতিসংঘ চিহ্নিত করেছে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে।

আর এইচআরডব্লিউ বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াওয়ের যেসব তথ্য-প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তা আন্তর্জাতিক আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। 

ওই অভিযান শুরুর পর গত আড়াই মাসে সোয়া ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যাদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় পাওয়া নির্যাতিত নারীদের পাশাপাশি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণকর্মী এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেছে এইচআরডব্লিউ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব বিবরণ এইচআরডব্লিউ পেয়েছে, তার মধ্যে একটি ছাড়া সবগুলোই দল বেধে ধর্ষণের। ছয়টি ঘটনায় বহু নারীকে এক জায়গায় জড়ো করার পর তাদের সামনেই অস্ত্রের মুখে গণধর্ষণ করা হয়েছে একজন একজন করে।  

 

# মংডুর হাটিপাড়া গ্রামের পঞ্চদশী কিশোরী হালা সাদাক বলেছেন, বর্মি সৈন্যরা তাকে বাড়ি থেকে তুলে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং প্রায় দশজন মিলে পালা করে পেছন থেকে ধর্ষণ করে। পাশবিক নির্যাতনের পর মৃত ভেবে তাকে ফেলে রেখে যায় তারা।

# রাথেডংয়ের চুট পাইন গ্রামে হামলা চালিয়ে কয়েক ডজন লোককে গুলি করে হত্যা করে বর্মি সেনারা। তাদের ধর্ষণের শিকার হন ৩৩ বছর বয়সী ফাতিমা বেগম। প্রথমে তার ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর এক সৈন্য তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলে মুখ চেপে ধরে মাটিতে শুইয়ে দেয়। তার শরীরের সঙ্গে চেপে ধরা হয় ছোরা, যাতে তিনি নড়াচড়া করতে না পারেন। ওই সময় আরও পাঁচজন তাকে পালা করে ধর্ষণ করে। মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করায় তাকে গুলি করার হুমকি দেওয়া হয়।

# সেনাবাহিনীর হামলার পর গ্রাম ছেড়ে এক পাহাড়ে পালিয়েছিলেন ৩৩ বছর বয়সী মমতাজ, ইউনিসসহ বেশ কয়েকজন নারী। কিন্তু সেখানে আর ২০ জন নারীর সঙ্গে তাদের ধরে ফেলে সৈন্যরা। মমতাজ বলেছেন, আটক নারীদের প্রথমে এক জায়গায় জড়ো করে সৈন্যরা। এরপর একজন একজন করে আলাদা করে সবার সামনেই ধর্ষণ করে। এই বিভৎসতার মধ্যে ফুঁপিয়ে কাঁদা ছাড়া কিছু করার ছিল না মমতাজদের।  

# মংডুর হাটিপাড়া গ্রামের ইশরাত বেগম (৪০) গতবছর অক্টোবরে সেনাবাহিনীর অভিযানের মধ্যে একবার এবং এবারের অভিযানের মধ্যে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হন। সবার সামনে সম্ভ্রম হারানোর সেই ঘটনা তাকে তাড়া করে ফিরছে।  

# বুথিডংয়ের টিন মে গ্রাম থেকে পালানোর সময় নিজের চোখের সামনে ৫ বছর বয়সী মেয়ে খাদিজাকে খুন হতে দেখেছেন ৩০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী শাজু হোসেন। সবাই যখন দৌঁড়াচ্ছিল, ছোট্ট খাদিজা কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। এক বর্মি সেনা রাইফেলের কুঁদো দিয়ে সজোরে মাথায় আঘাত করলে লুটিয়ে পড়ে খাদিজা। বাকি দুই সন্তানকে নিয়ে দৌঁড়াতে থাকা শাজু আর মেয়েকে বাঁচাতে পারেননি।

# হাটিপাড়া গ্রামের তৈয়বা জাহা নিজের বাড়ির সামনে তার ছয় সন্তানের মধ্যে তিনজনকে খুন হতে দেখেছেন। তারপর নিজে হয়েছেন উর্দি পরা সাত সৈন্যের ধর্ষণের শিকার। তার তিন শিশুর মধ্যে ২ ও ৩ বছর বয়সী দুই ছেলেকে বর্মি সেনারা হত্যা করে গাছের গুঁড়িতে মাথা ঠুকে ঠুকে। আর ৫ বছর বয়সী মেয়েকে উঠানে আছড়ে ফেলে খুন করে তারা।

তৈয়বা বলেন, “আমি জানি না, কেন তারা ওদের মারল। আমি খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না… মাথায় খালি নানা চিন্তা ঘোরে। আমার অন্য ছেলেমেয়েগুলো বাড়ি ফিরতে চায়। তারা বোঝে না যে আমাদের সব শেষ।”

এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে যারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছেন, এরকম শত শত নারীর ধর্ষিত হওয়ার তথ্য তাদের কাছে আছে। এই অংকও প্রকৃত সংখ্যার একটি অংশ মাত্র, কেননা নির্যাতিত নারীদের অনেকেই খুন হয়েছেন। যারা বাংলাদেশে আসতে পেরেছেন, তাদের অনেকে ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে চান না।

স্কাই হুইলার বলেন, এই নারী ও কিশোরীদের অনেকেই বড় ধরনের মানসিক আঘাতের কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। যে চিকিৎসা ও সহায়তা তাদের প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ কারণে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার তাগিদ দেন তিনি।   

হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মত ধর্ষণের অভিযোগও অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমারের সেনা কর্তৃপক্ষ। 

এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সীমান্ত সুরক্ষা মন্ত্রী গত সেপ্টেম্বরে প্রশ্ন তোলেন- এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ আছে কি না। 

তিনি বলেন, “যেসব মহিলা অভিযোগ করছে- তাদের দেখুন। বলুন তো, এদের কেউ ধর্ষণ করতে চাইবে?”