রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: উল্টো বাংলাদেশকে দুষছে মিয়ানমার

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো জবাব না দিয়ে উল্টো এখন বিলম্বের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করছে মিয়ানমার।  

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2017, 08:48 AM
Updated : 1 Nov 2017, 08:48 AM

দেশটির নেত্রী অং সান সুচির একজন মুখপাত্র বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য কোটি কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তা হাতে পাওয়ার আগে বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় কি না- সে বিষয়েই তাদের সন্দেহ রয়েছে।   

রাখাইন রাজ্যের গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে গত ২৫ অগাস্ট থেকে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। 

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের কারণে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে আছে গত কয়েক দশক ধরে।  

বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে, মানবিক কারণে আপাতত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও তাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই; সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সু চির দপ্তরের মহা পরিচালক জ তাই মঙ্গলবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। 

সেখানে তিনি বলেন, মিয়ানমার ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যে প্রস্তুত আছে, সে কথা আগেই জানানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।

“আমরা শুরু করতে চাই। কিন্তু অন্য পক্ষ তো এখনও সাড়া দিচ্ছে না। ফলে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

আর বুধবার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার অর্থ বাংলাদেশে আসার বিষয়টি টেনেছেন। 

“ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ৪০ কোটি ডলার পেয়েছে। তারা যেভাবে টাকা পাচ্ছে, তাতে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আরও বিলম্বিত হবে বলে আমাদের আশঙ্কা।… আমাদের মনে হচ্ছে, তারা হয়ত প্রত্যাবাসনের বিষয়ে নতুন কিছু ভাবতে পারে।”  

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় দুই দেশের বৈঠকে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর মাসের শেষ দিকে মিয়ানমারে যান বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

সেখানে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ ১০ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়।

রয়টার্স জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে; সেখানে বলা হয়েছে, ওই দশ দফা প্রস্তাবের বিষয়ে মিয়ানমার এখনও সম্মতি দেয়নি।    

মিয়ানমার বলে আসছে, রোহিঙ্গাদের পরিচয় এবং তাদের মিয়ানমারে বসবাসের তথ্য যাচাই হলেই তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে। 

জ তাই বলেছেন, তার দেশ এখন বাংলাদেশের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের তালিকার জন্য অপেক্ষা করছে।

১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে যে প্রত্যাবাসন চুক্তি করেছিল, তার আওতায় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে সে সময় ফিরিয়ে নিয়েছিল তারা। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে ‘মিয়ানমার থেকে আসা’ বলে চিহ্নিত করা হলেও তাদের আর তারা ফিরিয়ে নেয়নি।

গত অগাস্টে রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মধ্যে মিয়ানমারের তরফ থেকে বলা হয়, ১৯৯২ সালের চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রাখাইনের মুসলমানদের ফিরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত।

এর ধারাবাহিকতায় সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় এলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়।

১৯৯২ সালের চুক্তি এখন আর ‘বাস্তবসম্মত নয়’ জানিয়ে ওই বৈঠকে নতুন একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এগিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। এ বিষয়ে মিয়ানমারের জবাব এখনও বাংলাদেশ পায়নি।

গত ৯ অক্টোবর ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের চুক্তির নীতিমালা ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার তুলনায় অনেকটাই আলাদা। সুতরাং ওই চুক্তি অনুসারে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়।

১৯৯২ সালের ওই চুক্তির চতুর্থ দফায় রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়, যাদের কাছে মিয়ানমারের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জাতীয় নিবন্ধন কার্ড থাকবে, অথবা যারা জাতীয়তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারের যে কোনো দপ্তরের দেওয়া কোনো নথি দেখাতে পারবে এবং যারা মিয়ানমারে তাদের বসবাসের প্রমাণ দিতে পারবে- তাদের সবাইকে ধাপে ধাপে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার।  

কিন্তু গত মাসে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আসা একজন কূটনীতিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, যে অবস্থায় এই মানুষগুলো মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে, তাতে তাদের কাছে পরিচয়পত্র আশা করা কঠিন।

তাছাড়া রোহিঙ্গাদের কাছে জাতীয় পরিচিতির যেসব কাগজপত্র ছিল, গতবছরই সেগুলো বাতিল করে দিয়েছে মিয়ানমার।  

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন গত ২৬ অক্টোবর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে ফোন করে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন কোনো শর্ত না দিয়ে ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক পরদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হ্যাঁ, এখনকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। তবে আমরা মনে করি, ১৯৯২ সালের সমঝোতা যে প্রিন্সিপাল মেনে হয়েছিল, তাকে ভিত্তি ধরে এবারও আলোচনা এগিয়ে নেওয়া যায়।”

তার ওই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটও পরে বলেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির সঙ্গে নতুন বিষয় যোগ করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা ভাবতে পারে।