সেনাবাহিনীর নতুন দমন অভিযানের সম্ভাবনায় ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে মানুষের ঢল নেমেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর।
এর আগে গত বছরের অক্টোবরে প্রায় একই ধরনের হামলায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর বড় ধরনের দমন অভিযান চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সেসময় বেসামরিক রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছের এ রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত নিপীড়নের শিকার। তাদের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের তরফ থেকে আহ্বান জানানো হলেও তাতে মিয়ারমার সরকারের সাড়া মেলেনি।
দিন দশেক আগে সরকার রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সেনা মোতায়েন করলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। এরই মধ্যে মংডু জেলার মংডু ও বুথিদাউং উপজেলায় বৃহস্পতিবার রাতে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলা করে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা।
তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মংডু ও বুথিদাউং এলাকার বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে সমন্বিত এই হামলার সূচনা হয়।
মিজিমার খবরে বলা হয়, রোহিঙ্গা গেরিলাদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসী ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশ পোস্ট ঘিরে ফেলে এই হামলা চালায়।
ভোর ৩টার দিকে প্রায় দেড়শ হামলাকারী খামারা এলাকায় একটি সেনা ক্যাম্পে ঢোকার চেষ্টা করলেও প্রতিরোধের মুখে পিছিয়ে যায় বলে জানানো হয় সরকারের বিবৃতিতে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স জানায়, এবার হামলাকারীর সংখ্যা গত অক্টোবরের হামলাকারীদের থেকে অন্তত পাঁচগুণ বেশি। অন্তত ৫০টি গ্রামের হাজার খানেক বিদ্রোহী এ হামলায় অংশ নেয়।
এদিকে রাতের হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নতুন করে তৎপর হওয়ার পাশাপাশি কোনো কোনো স্থানে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ রাখাইনরা রোহিঙ্গা জনবসতিতে হামলা শুরু করেছে বলে খবর এসেছে। পাল্টা হামলায় আশঙ্কায় আতঙ্কে ভুগছেন রাখাইন গ্রামের বাসিন্দারাও।
শুক্রবার বিকালে মৌং মৌং চায় নামে হ্যামলেট গ্রামের এক রাখাইন রয়টার্সকে বলেন, “আমরা শুনেছি মুসলমান গ্রামবাসীরা একত্র হচ্ছে। তারা সূর্য ডোবার পর আমাদের ওপর আবার হামলা করবে।”
এদিকে অস্ত্রধারী একদল রাখাইনকে জেয় দি পাইন গ্রামের রোহিঙ্গা জনবসতিতে অন্তত ৭০০ রোহিঙ্গাকে ঘিরে রাখতে দেখার কথা বলেছেন রোহিঙ্গা মনিটরিং গ্রুপে কর্মরত ক্রিস লেওয়া।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ‘দি আরাকান প্রজেক্ট’র এই কর্মী সেখান থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছেন। সেই ৭০০ রোহিঙ্গার ভাগ্যে কী ঘটেছে তা তিনি জানতে পারেননি।
রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান এক সময় স্বাধীন রাজ্য থাকলেও অষ্টাদশ শতকের শেষভাবে বার্মার রাজা ওই এলাকা দখল করে নেন। আরাকানে জাতিগত বিভেদ তখন থেকেই।
গত শতকের চল্লিশের দশকের পর আরাকানে বৌদ্ধ মগ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে বহুবার জাতিগত দাঙ্গা লেগেছে। সামরিক শাসনামলে মিয়ানমারে ওই রাজ্যে চলেছে দফায় দফায় দমন অভিযান। রোহিঙ্গাদের বিভিন্নসংগঠন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পথেও হেঁটেছে।
মিয়ানমারে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে গত শতকের ৮০ এর দশক থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। তাদের ফিরিয়ে নিতে বার বার আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমারের সাড়া পাওয়া যায়নি।
রয়টার্স বলছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)’ রাতের হামলার দায় স্বীকার করেছে। এক সময়ে ‘হারাকা আল-ইয়াকিন’ নামে পরিচিত এই গ্রুপটিই গত বছরের অক্টোবরে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছিল।
এআরএসএ এর নামে করা একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এক পোস্টে হামলার দায় স্বীকার করে বলা হয়, “বার্মিজ নির্যাতনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫টির বেশি জায়গায় আমরা প্রতিরোধ কার্যক্রম চালিয়েছি। শিগগির আরও আসছে।”
রাখাইনের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেখে থাকে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির দলেরও অনেকে এই অবস্থানে আছেন। এই কারণে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে মিয়ানমার।
গত অক্টোবরে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান রাখাইন থেকে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই শরণার্থী সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার।
আগের মতো এবারও এক বিবৃতিতে হামলাকারীদের ‘বাঙালি’ আখ্যায়িত করেছে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সু চির কার্যালয়ের প্রেস কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবারের হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের নেত্রী সু চির কাছে হস্তান্তর করেন।
পরে ইয়াংগুনে এক সংবাদ সম্মেলনে নাগরিকত্ব না পাওয়ায় এবং নিদারুণ বৈষম্যের কারণ মুসলমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তাদের ওপর বলপ্রয়োগের পথ ছেড়ে মিয়ানমার সরকারকে যৌক্তিক সমাধানের পথে আসতে হবে।
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুক্রবার একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন সু চি, যাদের কাজ হবে কফি আনানের সুপারিশের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধানের পথ তৈরি করা।