জরায়ুতে ফাইব্রয়েড কতটা ভয়ের?

মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও পেট ব্যথা হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। এক পর্যায়ে শরীরে ভর করে প্রচণ্ড দুর্বলতা। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হল; জানা গেল জরায়ুতে বেড়ে উঠছে ফাইব্রয়েড।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2022, 06:40 PM
Updated : 21 Jan 2022, 07:43 PM

শারীরিক এই জটিলতা দীর্ঘদিন ধরে কাবু করছিল ঢাকার বাসিন্দা ২৪ বছর বয়সী গৃহিনী ফারিয়া ইসলামকে। তবে সমস্যা ধরা পড়ার পর চিকিৎসায় উপশম পেয়েছেন তিনি।

সেই অভিজ্ঞতার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়ে ফারিয়া বলেন, “প্রথমে তেমন সিরিয়াসলি নেইনি। কিন্তু পরে দেখলাম, দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। শরীর ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে, শক্তি পাচ্ছি না।”

ডাক্তারের পরামর্শে পরীক্ষা করে যখন জরায়ুতে ছোট ছোট চারটি ফাইব্রয়েড বা টিউমারের উপস্থিতি জানা গেল, চিকিৎসা নিতে দেরি করেননি ফারিয়া।

“ডাক্তার জানালেন, এগুলো এখনও খুব বেশি বড় হয়নি। ওষুধ দিলেন। বিয়ের পরপরই কনসিভ করে ফেললাম। তারপর সিজারের সময় ডাক্তার এগুলো ফেলে দিয়েছে। এখন আর তেমন কোনো সমস্যা নেই।”

ফাইব্রয়েড হল এক ধরনের টিউমার, যা জরায়ুর মসৃণ পেশি কোষ থেকে তৈরি হয়। প্রজননক্ষম বয়সে এ সমস্যা দেখা দেয়। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের কাছে গাইনি সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের একটি বড় অংশ মায়োমা বা ফাইব্রয়েড আক্রান্ত।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সাবেক প্রধান সালমা রউফ বলেন, ফাইব্রয়েড বেশি বড় হয়ে গেলে তলপেট ভারী লাগে, প্রস্রাব করতে সমস্যা হয়।

ফাইব্রয়েডের কারণে মাসিকের সময় বেশি পরিমাণে রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থা এবং প্রসবেও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। কারো বেলায় বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়ে উঠতে পারে ফাইব্রয়েড।

প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী ফাইব্রয়েডে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, পেট ব্যথা, কোমরের নিচে ব্যথা, ঘন ঘন প্রস্রাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, সহবাসের সময় ব্যথা বা অস্বস্তি বোধ করার মত উপসর্গে ভোগেন।

বেসরকারি চাকরিজীবী সুস্মিতা দাস বিয়ের চার বছর পার করেও সন্তানধারণ করতে পারছিলেন না। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার বেলাতেও জরায়ুতে ফাইব্রয়েড বা টিউমার ধরা পড়ে।

তিনি বলেন, “প্রথমে অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভবিষ্যতে সন্তান নিতে পারব কি না তা নিয়েও সংশয় কাজ করছিল। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেয়েও জটিলতা কমছিল না।

“অপারেশন করানো নিয়েও ছিল নানা শংকা। পেট কেটে অপারেশন করলে তো সিজারে অসুবিধা হতে পারে। জরায়ু কেটে ফেলতে হয় কি না, এগুলো মাথায় ঘুরছিল।”

অবশেষে চিকিৎসকের পরামর্শে ল্যাপারোস্কপিক সার্জারির মাধ্যমে ফাইব্রয়েড অপসারণের পর থেকে বেশ ভালো আছেন বলে জানালেন সুস্মিতা দাস।

“ল্যাপারোস্কোপি করে টিউমার ফেলে দেওয়ার পর এখন কোনো সমস্যা নেই। ডাক্তার ফলোআপে রেখেছেন। এখন নাকি কনসিভও করতে পারব।”

 

কারা বেশি ঝুঁকিতে?

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, ৫০ শতাংশ নারীরই ফাইব্রয়েড হয়ে থাকে। আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে এটি ধরা পড়ে।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের তথ্য অনুসারে, জরায়ুর যে কোনো অংশে ফাইব্রয়েড হতে পারে। আকৃতিতে এটি ছোট মটরদানা থেকে বাঙ্গির মত বড়ও হয়ে উঠতে পারে।

এর তিনটি ধরনের কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। জরায়ু দেয়ালের ভেতরে হলে ইন্ট্রামুরাল এবং বাইরের দিকে হলে সাবসেরোসাল ফাইব্রয়েড বলা হয়। যে অংশে ভ্রূণ থাকে, সেখানে বেড়ে ওঠে সাবমিউকোসাল ফাইব্রয়েড।

চিকিৎসক ফারাহানা দেওয়ান অভয় দিয়ে বলেন, “ফাইব্রয়েড ছোট ছোট থাকলে, সেটার কারণে অনেক বেশি ব্লিডিং না হলে বা সন্তানধারণে সমস্যা না হলে ফাইব্রয়েড ক্ষতিকর না।

“যখন বেশি ব্লিডিং হবে এবং প্রেগন্যান্সিতে সমস্যা তৈরি করবে, তখনই এটা ক্ষতিকর। তবে অনেকের কোনো লক্ষণই থাকে না। জরায়ুর ভেতরের দিকে ফাইব্রয়েড হলে মাসিকে সমস্যা বেশি হয়।”

ফাইব্রয়েড হওয়ার সঠিক কারণ এখনও অজানা। তবে যেসব বিষয় এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো চিহ্নিত করার কথা জানালেন স্ত্রী ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সারিয়া তাসনিম।

“সাধারণত যাদের সন্তান নেই, বন্ধ্যাত্ব সমস্যা আছে বা বাচ্চা অল্প বয়সে হওয়ার পর আর বাচ্চা নিচ্ছেন না, তাদের ক্ষেত্রে এটা হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে জেনেটিক কারণেও হয়ে থাকে।

“মা-বোনের থাকলে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইস্ট্রোজেন হরমোন বেশি থাকলেও ফাইব্রয়েড হতে পারে। সাধারণত ১৬ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীর শরীরে প্রজনন হরমোন ইস্ট্রোজেনের মাত্রা সর্বোচ্চ থাকে।”

যুক্তরাষ্ট্রের উইমেন্স হেলথ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০ থেকে ৮০ শতাংশ নারী ৫০ বছর বয়স হয়ে ওঠার আগেই ফাইব্রয়েডে আক্রান্ত হন।

প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন নারী জীবনের কোনো না কোনো সময় ফাইব্রয়েডের সমস্যায় ভুগে থাকেন বলে জানাচ্ছে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস।

অতিরিক্ত ওজনও শরীরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই অতিরিক্ত ওজন ফাইব্রয়েড হওয়ার ঝুঁকি দুই থেকে তিন গুণ বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া খাদ্যাভাসে অতিরিক্ত রেড মিট থাকলে নারীর জন্য ফাইব্রয়েড হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।

 

চিকিৎসা কী?

ফাইব্রয়েডের উপসর্গ দেখা দিলে নারীর জীবন অনেকক্ষেত্রেই যন্ত্রণাময় হয়ে ওঠে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, ওষুধের মাধ্যমে ফাইব্রয়েডের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

কারো জটিলতা বাড়লে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে। তবে জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভাসের পরিবর্তনে উপকার মিলবে। প্রচুর সবুজ সবজি খেলে ফাইব্রয়েড থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় বলে মনে করা হয়। পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রেণে রাখতে হবে।

যারা সন্তান ধারণ করেন, তাদের ঝুঁকি কম থাকে, বেশি সন্তান নিলে ঝুঁকি আরও কমে আসে বলে জানান চিকিৎসকরা।

ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ সারিয়া তাসনিম বলেন, “ফাইব্রয়েডের যে উপসর্গ, বেশি বেশি রক্ত যাওয়া; সেটি কমিয়ে রাখার ওষুধ আছে। তবে ওষুধের মাধ্যমে ফাইব্রয়েড বা টিউমার অপসারণ সম্ভব নয়।”

জরায়ুতে ফ্রাইব্রয়েড সাধারণত ‘বিনাইন’, অর্থাৎ এতে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে এই টিউমার হলে গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদানে জটিলতা তৈরি হতে পারে।

সেক্ষেত্রে জরায়ু থেকে ফাইব্রয়েড অপসারণে সমাধান মিলবে জানিয়ে এই চিকিৎসক বললেন, “এটি অপারেশন করে ফেলে দেওয়া যাবে। পেট না কেটে ল্যাপারোস্কোপি করেও অপসারণ করা যায়।”

ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে পেট না কেটে কয়েকটি ফুটো করে ক্যামেরা এবং অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র ঢুকিয়ে জরায়ু থেকে ফাইব্রয়েড সরিয়ে ফেলা যায়।

বিশেষ কোনো শারীরিক সমস্যা না হলে ফাইব্রয়েড ধরা পড়ার পরও ‘কিছু করার প্রয়োজন নেই’ বলে জানালেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের গাইনি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান সালমা রউফ।

তিনি বলেন, “জরায়ুর মাসল লেয়ারে তৈরি হওয়া এ ধরনের টিউমার ছোট থাকলে তেমন কোনো উপসর্গই থাকে না। সেক্ষেত্রে চিকিৎসারও প্রয়োজন হয় না। তবে সেটা বড় হচ্ছে কি না তা আল্ট্রাসাউন্ড করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।”

এ ক্ষেত্রে ছয় মাস বা এক বছর পরপর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে দেখার পরামর্শ দিয়ে এই গাইনি বিশেষজ্ঞ বলেন, “অনেকের ফাইব্রয়েডের আকার বড় হলে জরায়ু কেটে বাদ দিতে হতে পারে।”

গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের এই অধ্যাপক জানান, ফাইব্রয়েড যদি খুব বেশি বড় হয় এবং বয়স বেশি থাকে, সেক্ষেত্রে জরায়ু ফেলে দিতে হয় অনেক সময়।

“৪৫ বছরের বেশি হলে সেটা আমরা বলে থাকি, তার আগে বলি না। অল্প বয়স্কদের জরায়ু রেখে আমরা চিকিৎসা করি। এছাড়া জরায়ুর লাইনিংয়ের কাছে ছোট টিউমারগুলোকে হিস্টেরোস্কোপি করে দেখে কেটে ফেলে দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে পেট কাটার প্রয়োজন নেই।”

প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে ওষুধেও উপশম মিলতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “কিছু কিছু ওষুধ মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ কমায়। কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো টিউমারকে ছোট করে দেয়। বেশি ছোট হলে সেটা মিশেও যেতে পারে।”

ফ্রাইব্রয়েডের কারণে মাসিকের সময় রক্তপাত বেশি হলে যেসব খাবারে আয়রন আছে, সেগুলো বেশি করে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই গাইনি বিশেষজ্ঞ।

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এর অপসারণের বিষয়ে স্ত্রী ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ফারাহানা দেওয়ান বলেন, ফাইব্রয়েড ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে কেটে ফেলা যায়, আবার পেট কেটেও করা যায়।

“এটা বয়সের ওপর নির্ভর করে। যদি কম বয়স হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা জরায়ু অপসারণ না করে টিউমারটা অপসারণ করি।”

অবশ্য অপারেশনে ফাইব্রয়েড কেটে বাদ দেওয়া মানেই সব সময় রোগমুক্তি নয়। অনেক ক্ষেত্রে কিছুদিন পর আবার ফাইব্রয়েড হতে পারে বলে জানালেন চিকিৎসক ফারাহানা দেওয়ান।

“তাই যাদের বয়স বেশি, তাদের বেলায় আমরা জরায়ু কেটে ফেলি। তাহলে পরে আর ফাইব্রয়েড হওয়ার সুযোগ থাকে না।”

আবার নারী মেনোপজের (ঋতুস্রাব পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া) বয়সে পৌঁছে গেলে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে আসে, তাই ফাইব্রয়েড নিয়ে কিছু করার দরকার হয় না বলে জানালেন সালমা রউফ।

এই গাইনি বিশেষজ্ঞ বলেন, “মাসিক বন্ধ হওয়ার পর এটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আর ফাইব্রয়েড ছোট থাকলে মনোপোজের পর সেগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।”