বন্ধ্যাত্বে আশা দেখাচ্ছে ‘স্টেম সেল থেরাপি’

সন্তানহীন দম্পতিদের আশা দেখিয়ে কৃত্রিম উপায়ে গর্ভধারণে ‘স্টেম সেল থেরাপি’ নিয়ে বাংলাদেশে ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2021, 06:38 PM
Updated : 18 Dec 2021, 06:38 PM

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি বিভাগের একদল চিকিৎসক এই পরীক্ষায় যুক্ত আছেন।

এই দলের নেতা বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক জেসমিন বানু জানান, ডিম্বাশয়ে ডিম্বানুর পরিমাণ অনেক কমে যাওয়ার কারণে গর্ভধারণে অক্ষম নারীদের নিয়ে ‘স্টেম সেল থেরাপি’র এই পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ৩৪, ৩৬ ও ২৫ বছর বয়সী এই নারীদের একজনের মাসিক (ঋতুস্রাব) বন্ধ হয়ে গিয়েছিল; দুজনের মাসিক ছিল অনিয়মিত। ডিম্বানু না থাকায় তাদের বাচ্চা হচ্ছিল না।

গত ৩১ অক্টোবর তাদের রক্ত থেকে সংগ্রহ করা ‘স্টেম সেল’ তাদের ডিম্বাশয়ে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এই ট্রায়াল শুরু হয় বলে তিনি জানান।

স্টেম সেল এমন কোষ, যার সব ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে। লক্ষ কোটি কোষের সমন্বয়ে মানুষের দেহ তৈরি, আর কোষগুলোর কেন্দ্রে থাকে জোড়ায় জোড়ায় ক্রোমোজোম- যেটিকে বলা হয় বংশগতির মূল উপাদান।

মানুষের সমস্ত কোষের ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৩ জোড়া থাকলেও শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর ক্ষেত্রে তা অর্ধেক হয়ে যায়। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিজেদের মধ্যে মিলিত হয়ে যখন একক কোষ সৃষ্টি করে, তখন তাতে ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৩ জোড়া হয়ে যায়। এই কোষকেই বলা হয় স্টেম সেল, যার থেকে একটি সম্পূর্ণ দেহ তৈরি হয় নারীর গর্ভে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল আজীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে ‘স্টেম সেলের’ মাধ্যমে চিকিৎসা হচ্ছে।

“স্টেম সেল থেরাপি দেশে শুরুর মাধ্যমে একটা নতুন দ্বার উন্মোচন হতে পারে। অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা এই স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে সম্ভব।”

যেভাবে হয় স্টেম সেল থেরাপি

প্রথমে চিকিৎসাধীন নারীর রক্ত থেকে ‘স্টেম সেল’ আলাদা করা হয়। পরে তা তার ডিম্বাশয়ে স্থাপন করা হয়। এখন পরীক্ষায় দেখা যাবে এই প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে নতুন ডিম্বানু তৈরি হয় কিনা।

ডা. জেসমিন জানান বলেন, “যদি তাদের ডিম্বাশয়ে ডিম্বানু তৈরি হয়; সব স্বাভাবিক থাকে, তাহলে আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) বা টেস্টটিউবের মাধ্যমে আমরা মায়ের জরায়ুতে ভ্রুণ প্রতিস্থাপন করব।”

গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ জেসমিন বলেন, ‘স্টেম সেল থেরাপি’ দেওয়ার পর ডিম্বাশয়ে ডিম্বানু তৈরি হয়ে স্বাভাবিক গর্ভধারণ হতে পারে।

“কারও ক্ষেত্রে ডিম্বানু তৈরি হলেও স্বাভাবিক গর্ভধারণ নাও হতে পারে। তাদের জন্য টেস্টটিউব পদ্ধতি বেছে নিতে হবে।”

তিনি বলেন, যাদের ডিম্বানু তৈরি হয় না, তাদের স্টেম সেল থেরাপি না দিলে শুধু আইভিএফ পদ্ধতিতে টেস্টটিউবে বাচ্চা হবে না। কারণ তাদের ডিম্বানু আসবে না। এসব নারীকে ‘ওভারি ডোনেশন’ নিতে হয়। এর বিকল্প হিসেবে ‘স্টেম সেল থেরাপি’ নিয়ে এই গবেষণা।

“আমাদের দেশে ধর্মীয়ভাবে অন্যের ডিম্বানু নিয়ে গর্ভধারণ করলেও মা হওয়া যায় না। স্টেম সেল থেরাপি দেয়ার উদ্দেশ্য হল, নিজে যেন মা হতে পারেন।”

স্টেম সেল থেরাপি সফল হলে সন্তান দত্তক নেওয়া বা অন্যের ডিম্বানু থেকে গর্ভধারণের মতো মা হওয়ার বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে সামাজিক বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হবে মনে করেন ডা. জেসমিন।

পরীক্ষামূলক এই চিকিৎসায় চলতি মাসে আরও ৬ নারী অংশ নেবেন জানিয়ে তিনি বলেন, পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শেষে ফলাফল মূল্যায়ন করে নিয়মিত চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে।

কেন এই বন্ধ্যাত্ব

প্রতীকী ছবি

দেশে ঠিক কি পরিমাণ মানুষ বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ৪ কোটি ৮০ লাখ দম্পতি এবং ১৮ কোটি ৬০ লাখ ব্যক্তি বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভুগছেন।

প্রজনন বয়সী দম্পতিদের ১৫ শতাংশই এ সমস্যায় রয়েছেন। ১০ শতাংশের বেশি নারী সন্তান গ্রহণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন।

বন্ধ্যাত্ব সমস্যার পেছনে পুরুষ বা নারীর জটিলতা কিংবা উভয়ের মিলিত কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি ‘ব্যাখ্যাতীত’ কারণকেও দায়ী করছে সংস্থাটি।

ধুমপান, মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ, স্থুলতা, দূষণের শিকার হওয়ার মত পরিবেশগত ও জীবনযাত্রার কারণে বন্ধ্যাত্ব সমস্যা বাড়ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ হালিমা আক্তার হ্যাপি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নারীর ক্ষেত্রে ফাইব্রয়েড, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম, ডিম্বাণু নিঃসরণে অসুবিধাসহ ডিম্বাশয় ও জরায়ুর নানা সমস্যার কারণে সন্তানধারণ অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।

‘বেশি বয়সে গর্ভধারণের পরিকল্পনাও’ নারীদের জন্য বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিম্বাশয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম্বাণু থাকে, যার সংখ্যা ও মান বয়স বাড়ার সঙে সঙ্গে কমতে থাকে।

“বয়সজনিত, হরমোনাল ও পরিবেশগত কারণে কোনো কোনো নারীর ডিম্বাশয়ে ডিম্বানু উৎপন্ন হয় না বা ডিম্বানুর পরিমাণ কমে যেতে পারে।”

ডব্লিউএইচও বলছে, তিন দশকের বেশি সময় ধরে সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তির ব্যবহার চললেও তা বিশ্বের বড় অংশজুড়ে এখনো দুষ্প্রাপ্য। ফলে সন্তান নিতে ইচ্ছুক অনেকেই বিকল্প চিকিৎসার সুফল পাচ্ছেন না।

গত জুনে সুইজারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত স্টেম সেল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের চার গবেষকের এক প্রবন্ধে বলা হয়, আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই বন্ধ্যাত্ব সমস্যার সমাধান সম্ভব। আর অন্য সব সহায়ক পদ্ধতিগুলো যেখানে ব্যর্থ, সেখানেও স্টেম সেল থেরাপি আশা দেখাচ্ছে।

স্টেম সেল থেরাপির নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা বের করতে বড় পরিসরে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উপর জোর দেন তারা।