জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকি ৯০% কমিয়ে আনছে টিকা

হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভি টিকা জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারছে বলে উঠে এসেছে বড় পরিসরে করা এক গবেষণায়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2021, 04:21 AM
Updated : 12 Nov 2021, 04:21 AM

বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে এ গবেষণার ফলাফলকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, কারণ এ টিকা জীবন বাঁচাতে কাজে দিচ্ছে।

জরায়ুমুখের প্রায় সব ধরনের ক্যান্সারের প্রাথমিক কারণ ভাইরাস। এখন টিকার মাধ্যমে এ রোগ অনেকটাই নির্মূল করার আশা জাগছে।

গবেষকরা বলছেন, টিকা নেওয়া থাকলে নারীদের ক্যান্সার শনাক্তের স্মেয়ার পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও কমে আসতে পারে। 

বিবিসি লিখেছে, বিশ্বে ক্যান্সারে মৃত্যুর ঘটনায় নারীর জন্য চতুর্থ ঝুঁকি হচ্ছে জরায়ুমুখ ক্যান্সার। প্রতি বছর তিন লাখ নারী এতে মারা যায়।

আর জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রতি দশটি ঘটনার নয়টিই ঘটছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশে, যেখানে এ রোগ শনাক্তে জরুরি পরীক্ষা করার সুবিধা থাকে না।

যুক্তরাজ্যের মত ধনী দেশগুলোর চেয়ে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এইচপিভি টিকা অনেক বেশি সুফল বয়ে আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জরায়মুখ ক্যান্সার নিমূর্লে সফলতার কাছাকাছি যেতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিকল্পনার অধীনে এরই মধ্যে একশ দেশে এ টিকা কার্যক্রম চালু হয়েছে।

যুক্তরাজ্যে ১১ থেকে ১৩ বছরের কিশোরীদের এই টিকা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ২০১৯ সাল থেকে সেখানে ছেলেদেরও এই টিকা দেওয়া হচ্ছে, কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভি মুখগহ্বর, গলা ও মলদ্বারের ক্যান্সারের জন্যও দায়ী।

এইচপিভি টিকা শরীরে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পারে, তবে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে এই টিকা কাজ করে না। 

এই ভাইরাস সংক্রামক; তাই যৌন জীবন শুরুর আগেই এই টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য বিষয়ক জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যে মেয়েদের টিকা দেওয়ার পর কী ঘটছে তার ওপর নজর রাখছিলেন গবেষকরা।

ওই শিক্ষার্থীদের বয়স এখন বিশের মত। দেখা গেছে তাদের ক্যান্সার পূর্ববর্তী ঝুঁকি কমেছে; সেই সঙ্গে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঘটনাও ৮৭ শতাংশ কমেছে।

কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষক অধ্যাপক পিটার সাসিনি বলেন,“টিকার বড় একটি প্রভাব দেখা গেছে।”

তবে তরুণদের মধ্যে যাদের বয়স কিছুটা বেশি, তাদের শ্রেণিতে এই টিকার প্রভাব ততটা দেখা যায়নি। এর কারণ কম সংখ্যক তরুণী টিকা নিতে রাজি হয়েছিল এবং তাদের অনেকেরই টিকা নেওয়ার আগে যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এইচপিভি টিকা কর্মসূচির মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে অন্তত ৪৫০টি ক্যান্সার এবং ১৭ হাজার ২০০টি ক্যান্সার পূর্ব লক্ষণ ঠেকানো গেছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন।

অধ্যাপক পিটার সাসিনি বলেন, যারা টিকা নিয়েছে তারা এখনও যথেষ্ট কম বয়সী। সময় যত গড়াবে, টিকার কারণে জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে রেহাই পাওয়ার হার তত বাড়বে।

জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে ‘বেঁচে ফেরা’ লরা

রুটিন মাফিক পরীক্ষা করাতে গিয়ে লরা ফ্লহাটি জানতে পারেন, তিনি জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত।

“আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন তো এই এইপিভি টিকা চালুই হয়নি”, বিবিসিকে বলেন ২৯ বছর বয়সী এই নারী।

“আমি রুটিন মাফিক স্মেয়ার টেস্ট করিয়েছিলাম। এটি আসলে দেখিয়ে দিয়েছিল স্মেয়ার টেস্ট নিয়মিত করানো কতটা জরুরি। আমাকে জানানো হল, পরীক্ষায় অস্বাভাবিক কোষ দেখা গেছে এবং আমি এইচপিভি পজিটিভ।

“পরে আরও পরীক্ষায় জানা গেল, আমি স্টেজ ওয়ান জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ কারণে হিস্টেরেক্টমি বা জরায়ু অপসারণ করতে হয়।”

অপারেশনের আগে সন্তানদের জন্য বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন লরা।

তিনি বলেন,  “আমাকে বলা হল, খুবই দুঃখিত, এটি ক্যান্সার। আমার দুই সন্তান তখন ছোট। আমি তাদের বললাম, আমাকে বাঁচাতেই হবে তোমাদের। আমার বাচ্চাদের দেখাশোনা তো আমারই করতে হবে।”

সুস্থ হয়ে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লরা বলেন, “আমি এ বছর ফেব্রুয়ারিতে স্মেয়ার টেস্ট করিয়েছিলাম। অগাস্টে আমাকে রোগমুক্তির ছাড়পত্র দেওয়া হল। আমি সত্যিই ভাগ্যবান।”

জরায়ুমুখ ক্যান্সার শনাক্তে এখন প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পর পর নারীদের স্মেয়ার পরীক্ষা করাতে বলা হয়।

অধ্যাপক পিটার সাসিনি বলেন, নীতি নির্ধারকের সতর্ক হতে হবে এখনই। নতুন করে স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হবে। যারা টিকা নেয়নি তাদের বেলায় স্ক্রিনিং চালিয়ে যেতে হবে।

তবে এইচপিভি টিকা নিয়ে এসবই শেষ কথা নয়।

বিবিসি লিখেছে, টিকা কতদিন সুরক্ষা দেবে, মধ্য বয়সে টিকার বুস্টার ডোজ দিতে হবে কি না এমন অনেক প্রশ্নই রয়ে গেছে।

তাছাড়া প্যাপিলোমা ভাইরাস মিলেছে একশ রকমেরও বেশি ।

যুক্তরাজ্যে যে টিকা চালু হয়েছে তা এই ভাইরাসের দুটি ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে দেশটি শিগগিরই আরো একটি টিকা শুরু করবে যা এই ভাইরাসের নয়টি ধরনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। 

ভাইরাসের কিছু ধরন সংক্রমণের পর কোষের ডিএনএতে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটায়, সে কারণেই ক্যান্সার দেখা দেয়।

সংক্রমিত যে কোনো কোষেই এমন ঘটতে পারে। এই ভাইরাস যোনীপথ, মুখ এবং পায়ুপথে সংক্রমিত হতে পারে। এ কারণে পুরুষের লিঙ্গে, মাথা ও ঘাড়ে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

তবে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ৯৯ শতাংশই হয় হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে।

ক্যান্সার রিসার্চ ইউকের প্রধান নির্বাহী মাইকেল মিশেল বিবিসিকে বলেন, “এ সত্যিই ঐতিহাসিক মুহূর্ত; গবেষণার প্রথম ফলাফলেই দেখা গেছে জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে এই টিকা হাজার হাজার নারীকে বাঁচিয়েছে, আর আগামীতেও সুরক্ষা দেবে।”