‘অসচেতনতায়’ বাড়ছে পলিসিস্টিক ওভারি

মাসিক অনিয়মিত হচ্ছিল কৈশোর পার হওয়ার পর থেকেই। নানা জন নানা পরামর্শ দিচ্ছিলেন, কাজ হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ধরা পরল, রোগটা পলিসিস্টিক ওভারি।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Oct 2021, 04:01 PM
Updated : 3 Oct 2021, 04:01 PM

দেরিতে হলেও চিকিৎসা শুরু হয়েছে ৩১ বছর বয়সী নাসরিন সুলতানার। কিন্তু এখন তাকে সন্তান ধারণ নিয়ে ভুগতে হচ্ছে অনিশ্চয়তায়।

জীবন যাপনের ধরনে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে দেশে পলিসিস্টিক ওভারিতে আক্রান্তের সংখ্যা ‘বেড়ে যাচ্ছে’ বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

তারা বলছেন, অনেক নারী এ রোগে আক্রান্ত হলেও ব্যক্তিগত ও পারিবারের অবহেলায় চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

সন্তান ধারণে জটিলতা হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়টিকে রোগ হিসেবে তেমন গুরুত্ব দিতে চান না অধিকাংশ নারী। কিন্তু তাদের ভুগতে হয় দীর্ঘমেয়াদী নানা জটিলতায়। এমনকি সেটা জরায়ুর ক্যান্সারেও গড়াতে পারে।

এ রোগে আক্রান্ত কয়েকজন নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা।

১৯ বছর বয়সী আফরিনের মাসিক বেশ অনিয়মিত; ৩৫ থেকে ৪০ দিন পর পর হয়, কোনো কোনো মাসে আবার হয় না। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে এই তরুণী জানতে পারেন, তার পলিসিস্টিক ওভারি হয়েছে। 

আফরিন বলেন, “প্রায় এক বছর ধরে দেখলাম মাসিক ঠিকমত হচ্ছে না। প্রথমে কাউকে কিছু বলিনি। আম্মুকে জানানোর পর কয়েক মাস দেখতে বললেন।

“তারপর ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার সিম্পটম দেখে কিছু টেস্ট দিল। এরপর জানাল পলিসিস্টিক ওভারি হয়েছে আমার।”

নাসরিন সুলতানা জানালেন, তিনি অনিয়মিত মাসিকের সমস্যায় ভুগছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই। একজনের পরামর্শে কিছুদিন হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা করিয়ে ফল পেলেও পরে আবার মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দুই থেকে তিন বছর এভাবে যাওয়ার পর মাসিক বন্ধ হয়ে গেল। টানা তিন মাস মাসিক হল না। আবার খেয়াল করলাম, মুখে লোম বাড়ছে। অনেকে বলল হরমোনের সমস্যার কারণে এমন হচ্ছে।”

এরপর চিকিৎসকের কাছে গেলেন নাসরিন। গাইনির ডাক্তার বললেন দ্রুত বিয়ে করে ফেলতে। তাহলে নাকি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

“এরপর অন্য এক ডাক্তার দেখালাম। উনি বললেন, পলিসিস্টিক ওভারি হতে পারে। পরে আল্ট্রাসনোগ্রামে সেটাই ধরা পড়ল।”

এখন জীবন যাপনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন পুরান ঢাকার বংশালে থাকা এই নারী। নিয়মিত হাঁটছেন। কমিয়ে দিয়েছেন শর্করা ও তেলজাতীয় খাবার।

চিকিৎসকের কাছে ‘ওষুধে ভাল হয়ে যাওয়ার’ আশ্বাস পেলেও দুই বছরেও সন্তান ধারণ করতে না পারায় হতাশ তিনি।

নাসরিন বলেন, “মাসিক অনিয়মিত হওয়াটা যে একটা রোগ হতে পারে, এটা ভাবিনি। ...ডাক্তার আশা দিয়েছেন, কিন্তু জানি না কী হবে?”

বরাবরই অনিয়মিত মাসিক হত বলে জানালেন রায়েরবাগের বাসিন্দা শিফা জান্নাত। বিয়ের পর সন্তান না হওয়ায় গাইনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তখন জানতে পারেন, তিনি পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যায় ভুগছেন।

শিফা বলেন, “উনি (চিকিৎসক) জানালেন, দেরিতে ধরা পড়ায় কিছুটা সময় লাগবে। ওষুধে ঠিক না হলে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে।”

নিজে ভুগে শিফার উপলব্ধি, তার  ‘পরিচিত অনেক মেয়েরই এমন সিম্পটম’ রয়েছে।

“মা ও মেয়েরা হয়ত এগুলোকে গুরুত্বই দেন না। বলেন, এমনি ঠিক হয়ে যাবে। এটা ক্ষতি করে ফেলে, আমি নিজে বুঝেছি।”

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা পিসিওএস উপসর্গ 

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলছেন, পলিসিস্টিক ওভারি সমস্যার প্রধান লক্ষণ হল অনিয়মিত পিরিয়ড।

“প্রতি মাসে মাসে হয় না। এক থেকে দেড় মাস পরে হচ্ছে... আরও দেরিতেও হয়। অনেকের মাসিক লম্বা সময় ধরে বন্ধও থাকে।”

এমন সমস্যা নিয়ে কেউ এলে হরমোন পরীক্ষা করে দেখা হয় জানিয়ে এই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, “মেয়েদের শরীরেও ছেলেদের অ্যান্ড্রোজেন হরমোন থাকে। যখন এটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে তখন ঠিকমত মাসে মাসে ওভালুশন হয় না। তাই পিরিয়ডও ঠিকমত হয় না।”

এর আরও কিছু উপসর্গ থাকে জানিয়ে চিকিৎসক ফারহানা বলেন, “খুব ব্রণ হয় এবং শরীরে লোম বেড়ে যায়। আর ওজন বেশি থাকে। আজকাল আবার কেন যেন পাতলাদেরও হচ্ছে।

“মেয়েরা সন্তান ধারণ করতে পারে না। আবার সন্তান ধারণ করলেও বারবার গর্ভে বাচ্চা নষ্ট হয়।”

নারীরা বয়সের তিন পর্যায়ে এই সমস্যায় পড়তে পারেন; কিশোরী বয়সে, প্রজননক্ষম সময়ে  অর্থ্যাৎ ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সে এবং শেষ বয়সে।

আজকাল কম বয়সীদের বেলাতেও নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে বলে জানালেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ হালিমা আক্তার হ্যাপী।

তিনি বলেন, “আমরা যে রোগীগুলো পাই, তাদের বয়সের তুলনায় ওজন অনেক বেশি থাকে। শরীরে চুলের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, বিভিন্ন জায়গায় পিগমেন্টেশন থাকে। ঘাড়, বগলে কালো কালো দাগ থাকে।”

হালিমা আক্তার হ্যাপী বলেন, “আলট্রাসনোগ্রাম করে দেখা যায়, নেকলেস প্যাটার্নের মত ওভারির চারপাশে সিস্ট। এই সিস্টগুলো থেকে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন বের হয়।”

এর আরও লক্ষণ নিয়ে সতর্ক করে হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, “ডায়াবেটিস হতে পারে। এই সমস্যায় থাকা নারীদের ৪০ বছর হওয়ার আগেই ৪০ শতাংশের ডায়াবেটিস হয়ে যায়।”

নজর দিতে হবে জীবন যাপনে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক হালিমা আক্তার হ্যাপীর পর্যবেক্ষণ, পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যা এখন অনেক বেড়ে গেছে। আর জীবন যাপনের অনেক অভ্যাসই হয়ত এর জন্য দায়ী।

“আমরা বসে বসে থাকি। জাঙ্কফুড খাই বেশি বেশি। ওজন বেড়ে গিয়ে ফ্যাট থেকে এই অ্যান্ড্রোজেন হরমোনগুলো অনেক মাত্রায় আসে।”

পলিসিস্টিক ওভারি বংশগতও হয় বলে জানালেন অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম।

তিনি বলেন, “পরিবারের কারো এই সমস্যা থাকলে ধরে নিতে হবে অন্যদেরও সমস্যাটা আছে। সম্ভাবনা অনেক বেশি। মা-খালার সাথে এর সম্পর্কটা বেশি। সেজন্য সজাগ থাকতে হবে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, “প্রজননক্ষম নারীদের মধ্যে প্রধানত ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের এটা হয়। বাচ্চা হওয়ার পরও হয়। ৬০ বছর বয়সেও হয়, তবে সংখ্যাটা কম।

“সারা পৃথিবীতেই সমস্যাটা আছে; পাঁচ থেকে ২০ শতাংশ নারীকে এই সমস্যায় পড়তে হয়। আমরা এ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছি, তখন জানা যাবে আমাদের দেশে রোগী কেমন।”

এই চিকিৎসকের ধারণা, দেশে আনুমানিক দুই থেকে আড়াই কোটি নারীর পলিসিস্টিক ওভারি থাকতে পারে। তবে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনও তাদের হাতে নেই।

এ রোগের চিকিৎসায় দেরি হলে জরায়ু ক্যান্সারের মত সমস্যা হতে পারে বলে সতর্ক করলেন  স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান।

তার পরামর্শ, পলিসিস্টিক ওভারি কমাতে হলে বিশেষ করে মায়েদের কাউন্সেলিং করা সবচেয়ে জরুরি।

“মাসিকে সমস্যা হলেই ডাক্তারের কাছে এসে সনোগ্রাফি করে চিকিৎসা নিতে হবে।”

অল্প খরচে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীনভাবে এর চিকিৎসা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “কিছু ওষুধ দেওয়া হয় পিরিয়ড রেগুলার করার জন্য। আমরা লাইফস্টাইলে নজর দিতে বলি। একটু ডায়েটটা বদল করতে বলি।

“কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে প্রোটিন আর শাক বেশি খেতে হবে। যাতে তাদের ক্যালোরিটা ঠিক থাকে, হেলদি ফুডে আসতে হবে। অবশ্যই এক্সারসাইজ করতে হবে। সেটা ঘরেও হতে পারে বা জিমে।”

চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, যত দ্রুত এই রোগের চিকিৎসা করা যাবে ততই জটিলতা কমবে; আর সেজন্য সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের।

“অনেক মেয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় থাকে, তারা ডাক্তারের কাছে যায় না। কেউ হয়ত মাসিকের সমস্যায় কোনো একটা ডাক্তার দেখাল, কিছু ওষুধ খেল... এভাবে অনেকেই চিকিৎসার বাইরে থাকছে।”

ওজম কমানোর দিকে বিশেষ নজর দিতে পরামর্শ দিলেন হালিমা আক্তার হ্যাপী। বললেন, তাতে সমস্যার ৫০ ভাগ সমাধান সম্ভব; বাকিটা নির্ভর করে চিকিৎসার উপর।

“ওজন কমানোটা কিন্তু সহজ ব্যাপার না। আগের লাইফস্টাইল থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে। সেজন্য এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা। অনেকে ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন, মনে করেন চিকিৎসায় কাজ করছে না।”

এই চিকিৎসকের পরামর্শ, জাঙ্কফুড-ফাস্টফুড ও তৈলাক্ত খাবার বাদ দিতে হবে। কোমল পানীয় একেবারে এড়িয়ে চলতে হবে।

“বাসায় তৈরি খাবার, শাক-সবজি, মাছ, মাংস, ডিম যেগুলোকে আমরা আদর্শ খাবার বলি, সেগুলো খেতে হবে। জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যদি পরিবর্তন আনা যায়, তাহলে আমরা যে ওষুধটা দেব সেটা ভালো কাজ করবে।”

তিনি বলেন, “আমরা যারা বন্ধ্যাত্ব নিয়ে কাজ করি, এই রোগীগুলো তাদের কাছে আসে। যাদের অ্যান্ড্রোজেন হরমোন অতিমাত্রায় নিঃসৃত হয়, তাদের জন্য আমরা হরমোন বিশেষজ্ঞের সাথেও কনসাল্ট করি।”

এর কোনো প্রতিষেধক নেই জানিয়ে হালিমা আক্তার হ্যাপী বলেন, সবাইকে সচেতন করতে সেপ্টেম্বর মাসকে ‘পলিসিস্টিক ওভারি অ্যাওয়ারনেস মান্থ’ হিসেবে পালন করা হয়।

“স্কুল-কলেজের মেয়েদের যাদের মাসিক শুরু হচ্ছে, তাদের যদি সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, মাসে তাদের জন্য দুই-তিনটা সেমিনার করি, তাহলে তারাও সচেতন হত।”