পশ্চিমবঙ্গে দুই নারীর উদ্যোগ ‘ব্রেস্ট মিল্ক ডোনার’ ডেটাবেইজ

দুধের জন্য মা হারা নবজাতকের কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দুই তরুণীকে। মহামারীর এই সময়ে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবককে সঙ্গে নিয়ে ব্রেস্ট মিল্ক ডোনারদের ডেটাবেইজ করতে এগিয়ে আসেন তারা।

আইরিন সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2021, 05:30 AM
Updated : 3 Sept 2021, 09:27 AM

 বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বৈদেহী দাস ও মনিময়ী চক্রবর্তী জানিয়েছেন, তাদের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্রেস্ট মিল্ক রিসোর্স নেটওয়ার্ক’ বা ডব্লিউবিবিএমআরএন মূলত শিক্ষার্থীদের একটি উদ্যোগ। এর যাত্রা শুরু হয় গত ২০ মে।

ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ হায়দরাবাদের গবেষক বৈদেহী দাস বললেন, “আসলে প্যানডেমিক পরিস্থিতির অন্যতম শিকার হচ্ছে সদ্যজাত শিশুরা। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এই সময় অনেক প্রসূতি মারা যাচ্ছেন।

“মা হারানো নবজাতক, যার জন্য মায়ের বুকের দুধ জরুরি, তাকে নিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদের জন্য সময়টা কঠিন হয়ে ওঠে। এমন করুণ মুহূর্তে মানবিক জায়গা থেকে ওইসব পরিবারের শিশুকে মাতৃদুগ্ধ দিয়ে সাহায্য করতে আগ্রহী কোনো মায়ের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতেই আমাদের এই উদ্যোগ।”

এই ডেটাবেইজে কী ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে? কীভাবে তা কাজে লাগানো হচ্ছে? বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের শিক্ষার্থী মনিময়ী চক্রবর্তী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ডব্লিউবিবিএমআরএন মিল্ক ব্যাংক নয়, এটি একটি ডেটাবেইজ। মাতৃদুগ্ধদানে ইচ্ছুক মায়েদের তথ্যভাণ্ডার।

“পশ্চিমবঙ্গের মা হারা নবজাতক ও শিশুর পরিবারের, মাতৃদুগ্ধ দানে ইচ্ছুক মায়েদের ফোন নম্বর, ঠিকানা ইত্যাদি আমরা গুগল স্প্রেডশিটে একত্রিত করেছি। এছাড়া পেডিয়াট্রিশিয়ান ও ম্যাটারনিটি ক্লিনিকের তথ্যও রাখা হয়েছে এই ডেটাবেইজে।”

সোশাল মিডিয়াতে গত ২৮ মে এই ডেটাবেইজ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয় বৈদেহী ও মনিময়ীর উদ্যোগ ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্রেস্ট মিল্ক রিসোর্স নেটওয়ার্ক।

দাতা ও হাসপাতালের জেলাভিত্তিক তালিকা ছাড়াও কয়েকজন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদেরও নাম যোগ করা হয়েছে সেখানে।

এই উন্মুক্ত ডেটাবেইজে কী দাতা এবং মা হারা শিশুর পরিবারের তথ্য গোপনীয়তা থাকছে?

বৈদেহী দাস জানালেন, মাতৃদুগ্ধদাতা ও গ্রহীতা পরিবারের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়ে পুরোপুরি গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। ডব্লিউবিবিএমআরএনের অনলাইন ডেটাবেইজেও দাতাদের পুরো নাম না দিয়ে পরিচয় দেওয়া হয়েছে কেবল নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে।

বৈদেহী বলেন, “এই যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমরা এমনকি আইনি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নিয়ে থাকি।”        

মহামারীর কারণে বুকের দুধ ডোনারের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়েও সজাগ রয়েছে ডব্লিউবিবিএমআরএন।    

“ডোনারের মেডিকেল হিস্ট্রি জেনে নেওয়া হয়। এছাড়া হাসপাতালে ডোনারকে হেলথ স্ক্রিনিং এর মধ্যে দিয়েও যেতে হয়”, বলেন মনিময়ী চক্রবর্তী।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুসরণ করা হয় জানিয়ে ডব্লিউবিবিএমআরএন বলছে, সংক্রমণের কোনো রকম ঝুঁকি রয়েছে কি না যাচাই করতে বুকের দুধ দাতাকে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। নিজের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর পর পর্যাপ্ত দুধ উদ্বৃত্ত থাকতে হবে।     

বৈদেহী দাস ও মনিময়ী চক্রবর্তীর এই উদ্যোগ কেমন সাড়া ফেলেছে?

যাত্রা শুরু হওয়ার পর মাস খানেকের মধ্যেই প্রায় ১৮ জনের মত ডোনার নিয়ে তালিকা করতে পেরেছে ডব্লিউবিবিএমআরএন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়ার পর টালিগঞ্জের অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জি এই উদ্যোগ সমর্থন জানিয়ে ২১ মে ইনস্টাগ্রামে এবং পরে ফেইসবুকেও পোস্ট শেয়ার করেন বলে জানালেন বৈদেহী ও মনিময়ী।  

তাদের এই উদ্যোগের কথা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও আলোচিত হচ্ছে। অধিকাংশের কাছে সাধুবাদ পেলেও‘কিছু নেতিবাচক’ অভিজ্ঞতা যে হয়েছে সে কথাও বললেন উদ্যোক্তারা।

মনিময়ী চক্রবর্তী বলেন, বুকের দুধ অন্য কারো সন্তানকে দেওয়া নিয়ে “সমাজে এখনও অনেক ধরনের স্টিগমা কাজ করে।”

আর বৈদেহী বলেন, “সোশাল মিডিয়াতে ব্রেস্ট মিল্ক ডোনার আহ্বান করে দেওয়া পোস্টগুলোতে আমাদের নাম আর ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছিল। ওইসব পোস্টে ব্রেস্ট শব্দটাও এসেছে...।

“দুজন মেয়ের নাম, তার উপর ব্রেস্ট মিল্ক নিয়ে কথা... তো ডোনার সেজে অনেকে ফেইক কল করত।” 

অনেকে ফোন করে অনেক বাজে মন্তব্য করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আসলে মানুষের অসচেতনতা আর এই সোশাল স্টিগমাই এই কাজে মূল বাধা।”

তবে তাতে হতোদ্যম হননি বৈদেহী দাস ও মনিময়ী চক্রবর্তী। বরং বাজে সংস্কার ভেঙে দিতে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে ব্যাখা ও পরামর্শমূলক পোস্ট তারা ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রামে দিয়ে আসছেন।

ব্রেস্ট মিল্ক ডোনার চেয়ে ডব্লিউবিবিএমআরএন থেকে সোশাল মিডিয়াতে একটি প্রচারণামূলক পোস্টে বলা হচ্ছে, “সেইভ এ চাইল্ড, ব্রেক দ্য স্টিগমা।”  

তাদের ভাষ্যে, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর ইউনিসেফের একটি জরিপ অনুসারে সারা বিশ্বে ৮০ হাজারের মত শিশুর মৃত্যু ঠেকানো যেত যদি তাদের ব্রেস্ট মিল্ক ডোনেট করে খাওয়ানো হত।

“যখন কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে শিশুকে নিজের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হয় না, তখন প্রথম বিকল্পই হচ্ছে অন্য কোনো সুস্থ মায়ের বুকের দুধ নিয়ে শিশুকে খাওয়ানো।”

গত ১১ অগাস্ট ২ মাস বয়সী শিশুর জন্য ব্রেস্ট মিল্ক ডোনার চেয়ে সোশাল মিডিয়াতে একটি পোস্ট করে ডব্লিউবিবিএমআরএন। এরপর ডোনারদের কাছ থেকে সাড়াও পান তারা।

মনিময়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আমাদের নিজেদের যে ডোনার লিস্ট সেখান থেকেই সাড়া পেয়েছি।

“ডাক্তাররা ব্রেস্ট মিল্ক ইনডিউস করাতে পারেন। কিন্তু এই ঘটনায় সেটাও ডিফিকাল্ট ছিল। আমরা আরও ডোনার খুঁজছি... দূরত্বের কারণে ট্রান্সপোর্টেশনের একটু অসুবিধে রয়েছে। আসা-যাওয়ার মধ্যে মিল্ক কনটামিনেশন হওয়ার ঝুঁকি রয়ে যায়। তবে আপাতত বাচ্চাটা দুধ পাচ্ছে।”

মহামারীর কঠিন সময়ে ডব্লিউবিবিএমআরএনের সূচনা হলেও এর কাজের পরিধি ধীরে ধীরে বাড়ছে বলে জানালেন তিনি।

মনিময়ী বলেন, “কোভিড কালে একটা বিশেষ চাহিদা দেখা দিচ্ছিল। যেমন কেউ বাচ্চা থেকে দূরে রয়েছেন, অথবা মা মারা গেছে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে আরও জরুরি চাহিদা আছে।

“অনেকে পর্যাপ্ত বুকের দুধ দিতে পারেন না বাচ্চাকে। তার জন্য ল্যাকটেশন এক্সপার্টও রয়েছেন আমাদের সাথে। এরকম কাউকে পেলে আমরা সেই এক্সপার্টের সাথে কথা বলাই প্রথমে কাউন্সেলিং করাতে। মা বাচ্চার জন্য পর্যাপ্ত দুধ দিতে না পারলে তখন আমরা ডোনারদের কাছে যাই। ডোনার রয়েছে...আরও বাড়বে।”