শিশুর জন্য মায়ের দুধ কেন জরুরি

মহামারীতে বিপর্যন্ত এই পৃথিবীতেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে শিশুর ভবিষ্যত সুরক্ষায় মায়ের দুধকেই সেরা দাওয়াই মানছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2021, 02:56 PM
Updated : 1 August 2021, 02:57 PM

তারা বলছেন, শিশুর নানা শারীরিক জটিলতা আর মৃত্যুঝুঁকি কমাতে মাতৃদুগ্ধ হল রক্ষাকবচ। তাই কোনো অবস্থাতেই দুই বছর পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

সেজন্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মায়েদেরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে বলছেন চিকিৎসকরা।

এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে রোববার শুরু হয়েছে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে এই কর্মসূচি চলছে। এ বছর বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য- ‘প্রটেক্ট ব্রেস্টফিডিং, এ শেয়ারড রেসপনসিবিলিটি’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে প্রতি পাঁচটি শিশুর তিনজনই জন্মের প্রথম ঘণ্টায় মাতৃদুগ্ধ পায় না। দুই বছর পর্যন্ত স্তন্যপান করাতে পারলে বছরে ৮ লাখ ২০ হাজার শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব।

মায়ের দুধ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটায়। বুকের দুধ না পেলে পরে শিশুর শরীরে হানা দিতে পারে নানা ব্যাধি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিওনেটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মনিষা ব্যানার্জী বলেন, শিশুর জন্য এই আদি ও অকৃত্রিম পানীয়র চেয়ে উপকারি কিছু পৃথিবীতে নেই।

“মায়ের দুধ সর্বোত্তম, এর কোনো বিকল্প নেই। শিশুর গড়ে ওঠার জন্য যা যা পুষ্টির দরকার, সবকিছু মায়ের দুধে আছে।”

কর্মব্যস্ততা, শিশুকে বেশি খাওয়ানোর প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণে কৌটাবন্দি দুধে নির্ভরতা বেড়েছে অভিভাবকদের। তাতে যে শিশুর জন্য বিপদ ডেকে আনা হচ্ছে, সেটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

বুকের দুধ কতটা জরুরি- তা ব্যাখ্যা করে ডা. মনিষা বলেন, “ভ্রূণ অবস্থা থেকে জন্মের দুই বছর পর্যন্ত শিশুর মস্তিষ্কের ৮০ শতাংশ বিকাশ হয়ে যায়। মস্তিষ্কের বিকাশে ‘টরিন’ নামের অ্যামাইনো এসিডসহ কিছু পুষ্টি উপাদানের বড় ভূমিকা রয়েছে, যেগুলো বুকের দুধ ছাড়া কোনো খাবারে মিলবে না।

“যে বাচ্চারা কৌটোর দুধ খেয়ে বড় হচ্ছে, তাদের চেয়ে বুদ্ধিমত্তায় বুকের দুধ পাওয়া শিশুরা এগিয়ে থাকবে।”

শিশু বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, “আমরা দেখেছি এবং বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে, যে শিশুরা ফর্মুলা মিল্ক খায়, তাদের ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কান পাকা- এগুলো মায়ের দুধ খাওয়া শিশুদের তুলনায় ৭-৮ গুণ বেশি হয়। গরুর দুধে বাচ্চাদের কিছু অ্যালার্জি হয়, সেগুলো হবে না মায়ের দুধে।

“ফর্মুলা খেয়ে বড় হওয়া শিশুদের ওজন অনেক বেশি হয়, এজন্য সে পরে নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ওজন বেশি থাকলে ভবিষ্যতে উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ, ডায়াবেটিসের মত রোগগুলোর ঝুঁকি বেড়ে যায়। মায়ের দুধে থাকা শিশুদের সে সম্ভাবনা খুবই কম।”

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মায়েদের জন্য তার পরামর্শ, “বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুর কোভিড আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একেবারেই নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে দুধ খাওয়ালে কোনো অসুবিধা নেই।”

এই চিকিৎসকের ভাষায়, বুকের দুধ মা ও শিশুর যে বন্ধন তৈরি করে, তার কোনো তুলনা নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, জন্মের প্রথম ঘণ্টাতেই নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র বুকের দুধই খাবে শিশু, এমনকি পানিও খাওয়ানো যাবে না। এরপর পরিপূরক খাদ্যের সঙ্গে অন্তত দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ চালিয়ে যেতে হবে।

অধ্যাপক মনীষা ব্যানার্জি বলেন, দুই বছরের পরেও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে, তবে বাড়তি খাবার দিয়ে পুষ্টি পূরণে নজর দিতে হবে।

দুগ্ধদান করে মায়েরাও জীবনসংহারী অনেক রোগ ঠেকিয়ে দিতে পারেন; সেজন্য তাদের আরও উৎসাহিত করতে বলছেন চিকিৎসকরা।

স্ত্রী ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সারিয়া তাসনিম জানান, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে হবে। বাচ্চা বুকের দুধ টানলে মায়ের শরীর থেকে অক্সিটোসিন হরমোন বের হয়, যেটি জরায়ুকে সংকোচনে সহায়তা করে।

“এতে মায়ের গর্ভফুল তাড়াতাড়ি পরে। গর্ভফুল আটকে যাওয়ার জটিলতাটা হবে না এবং প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণের ঝুঁকিও একদম কমে যাবে। আমাদের দেশে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ। এটা কমাচ্ছে মায়ের বুকের দুধ।

“যারা ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ দেন এবং দুই বছর পর্যন্ত তা চালিয়ে যান; তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিও খুব কম। জরায়ু ক্যান্সার থেকেও এটি তাদের সুরক্ষা দিচ্ছে।”

ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের এই অধ্যক্ষ বলেন, “গর্ভাবস্থায় হরমোনের প্রভাবে শরীরে পরিবর্তন আসে। বাড়তি চর্বি জমে। বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে এই বাড়তি ওজন বৃদ্ধি এবং জমা চর্বি তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে পারে।

“গর্ভাবস্থায় জরায়ু অনেক বড় হয়ে যায়। বাচ্চা হওয়ার পর সেটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে। এই প্রক্রিয়াটাও তাড়াতাড়ি হয় বুকের দুধ খাওয়ালে।”

বৈশ্বিক সব সমীক্ষাতেই মাতৃদুগ্ধ পানে বাংলাদেশের অবস্থান সামনের সারিতে। ওয়ার্ল্ড ব্রেস্টফিডিং ট্রেন্ডস ইনেশিয়েটিভের র‌্যাংকিংয়ে মাতৃদুগ্ধ পান করানোয় বাংলাদেশ বিশ্বে এক নম্বর।

ইউনিসেফের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৫৫ শতাংশ শিশু ছয় মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের দুধ পান করে, বিশ্বে যে হার ৪২ শতাংশ।

বাংলাদেশ বেস্টফ্রিডিং ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সারিয়া তাসনিম মনে করেন, মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মাতৃদুগ্ধ পানে সাফল্য আসছে।

তবে আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “ভালো অবস্থানে গিয়েছি বলে আনন্দ চিত্তে হাত গুটানোর সুযোগ নেই। প্রতিদিনই নতুন নতুন মা যুক্ত হচ্ছে, সবার নলেজ লেভেল ঠিক থাকবে না। তাই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।”

তার মতে, মায়েদের কর্মব্যস্ততা আর পারিপার্শ্বিক কিছু মিথে অনেক বাড়িতে কৌটার দুধ ঢুকে পড়ছে। সেজন্য পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপ ভাঙার চ্যালেঞ্জ উৎরাতে বলছেন তিনি।

“দুধ খাওয়াতে চায় না এমন মা কমই আছে। কিন্তু শিশু কান্নাকাটি করলে বাড়ির লোকজন বলে পেট ভরছে না, দুধ আসছে না; এতে মায়ের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সংসারের কাজের চাপেও দুধ খাওয়ানোর সমস্যা হয়ে যায়। অনেক কর্মজীবী মাকে ছয় মাসের আগেই কাজে চলে যেতে হয়। আবার কেউ কেউ দুধ খাওয়ানোর কৌশল জানেন না।

“এজন্য প্রথমে মায়ের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে সে দুধ খাওয়াতে পারব। দ্বিতীয়ত তার যেন দুশ্চিন্তা বা কাজের তাড়াহুড়া না থাকে। কর্মজীবী হলে মা বুকের দুধও রেখে দিতে পারেন, যাতে বাড়িতে না থাকলেও ফর্মুলা মিল্ক দিতে না হয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা এবং ফ্রিজে ২৪ ঘন্টা দুধ ভাল থাকে।”

এই চিকিৎসক জানান, প্রথম দুই-তিন দিন মায়ের দুধ কম এলেও তাতে পুষ্টিগুণ অনেক বেশি থাকে; যা শিশুর জন্য প্রথম টিকা।

“মায়ের দুধ বাচ্চার জন্য সবচেয়ে উপকারি ও উপযোগী খাবার। বুকের দুধে শুধু পুষ্টি উপাদান নয়, এমন উপাদান থাকে, যা খাবার হজমে সাহায্য করে।”